কাফকো থেকে ৩০ হাজার টন সার কিনবে সরকার

সরকার শিল্প খাতে ইউরিয়ার চাহিদা পূরণে নতুন একটি বড় ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। কর্ণফুলী ফার্টিলাইজার কোম্পানি লিমিটেড (কাফকো) থেকে ৩০ হাজার মেট্রিক টন ব্যাগড গ্র্যানুলার ইউরিয়া সার কেনার প্রস্তাব অনুমোদন দিয়েছে সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি। এই চুক্তির মাধ্যমে ব্যয় হবে প্রায় ১৪২ কোটি ৮৭ লাখ ৭২ হাজার ৫০০ টাকা।
মঙ্গলবার (২২ এপ্রিল) মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত কমিটির বৈঠকে ভার্চ্যুয়ালি সভাপতিত্ব করেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমদ। বৈঠকে শিল্প মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবের ভিত্তিতে এ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
কাফকোর সঙ্গে দীর্ঘদিনের সহযোগিতা
বাংলাদেশে ইউরিয়া সারের অন্যতম প্রধান উৎস কাফকো। চট্টগ্রামের আনোয়ারায় অবস্থিত এই কারখানাটি যৌথ মালিকানাধীন একটি প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশ সরকার ও জাপান, ডেনমার্ক, নেদারল্যান্ডস, কুয়েত ও সৌদি আরবের কিছু বেসরকারি কোম্পানির যৌথ উদ্যোগে গঠিত এই প্রতিষ্ঠানটি ১৯৮০’র দশক থেকে দেশের কৃষি ও শিল্পখাতে সার সরবরাহ করে আসছে।
বর্তমান চুক্তির আওতায় ১৫তম লটে এই ইউরিয়া কেনা হবে। প্রতিটি মেট্রিক টনের দাম পড়বে ৩৯০.৩৭৫ মার্কিন ডলার। বিশ্ববাজারের সাম্প্রতিক মূল্য বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে এ দামকে তুলনামূলক স্থিতিশীল বলা যেতে পারে।
জাতীয় পর্যায়ে ইউরিয়ার গুরুত্ব
বাংলাদেশে ইউরিয়া সারের চাহিদা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। বিশেষ করে কৃষিক্ষেত্রে এর ব্যবহার ব্যাপক। বর্তমানে দেশের কৃষি উৎপাদন নির্ভর করছে যথাযথ পরিমাণে ইউরিয়া সারের প্রাপ্যতার উপর। এই চাহিদা পূরণে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন উৎস থেকে সার আমদানি করা হয়।
তবে কাফকোর মতো স্থানীয় উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান থেকে ইউরিয়া সংগ্রহ সরকারের জন্য অধিকতর লাভজনক এবং সময় সাশ্রয়ী। কারণ বিদেশ থেকে আমদানি করলে বিভিন্ন জটিলতা ও খরচ যুক্ত হয় যা কাফকোর ক্ষেত্রে তুলনামূলক কম।
সরকারিভাবে ক্রয় সংক্রান্ত স্বচ্ছতা
সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকগুলোতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে বিভিন্ন দফতর ও বিভাগের প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করেন। এবারের বৈঠকে শিল্প মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি অর্থ মন্ত্রণালয়, পরিকল্পনা কমিশন এবং সংশ্লিষ্ট নিয়ন্ত্রণ সংস্থার কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠক সূত্রে জানা যায়, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের নির্ধারিত বাজেটের আওতায়ই এ ক্রয় প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে। এতে জাতীয় অর্থনীতিতে চাপ না পড়লেও, ইউরিয়া সারের দাম ও প্রাপ্যতা নিয়ন্ত্রণে থাকবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
ঘোড়াশাল পলাশ ফার্টিলাইজারে প্রযুক্তিগত সহায়তা
এই বৈঠকে শুধু কাফকোর ইউরিয়া ক্রয়ের প্রস্তাব নয়, আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব অনুমোদন পেয়েছে। ঘোড়াশাল পলাশ ফার্টিলাইজার পিএলসি (জিপিএফপিএলসি)-এর উৎপাদন সক্ষমতা ও রক্ষণাবেক্ষণ উন্নয়নে জাপানের সাধারণ ঠিকাদার (জেনারেল কনট্রাক্টর) এমএইচআই-এর সঙ্গে এক বছরের প্রযুক্তিগত সহায়তা চুক্তি অনুমোদন করা হয়েছে।
এ চুক্তির আওতায় এমএইচআই প্রতিষ্ঠানটি কারিগরি সহায়তা প্রদান করবে এবং দিনে দিনে উৎপাদন ও রক্ষণাবেক্ষণে অবদান রাখবে। এতে ব্যয় হবে ৭৬ কোটি ৩৪ লাখ ৭ হাজার ৩৭৫ টাকা।
সার নিরাপত্তা ও আত্মনির্ভরতা
বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশে সার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে শুধু আমদানির ওপর নির্ভর না করে স্থানীয় উৎপাদন সক্ষমতা বাড়াতে হবে। ঘোড়াশাল, পলাশ, ফেনী ও গাজীপুরে অবস্থিত বিভিন্ন সার কারখানাগুলোকে আধুনিকায়ন ও রক্ষণাবেক্ষণের মাধ্যমে উৎপাদন বাড়ানো গেলে আমদানি নির্ভরতা অনেকটাই কমে আসবে।
সরকার ইতোমধ্যে ঘোড়াশাল-তিতাস গ্যাস ফিল্ডের সঙ্গে সংযুক্তি তৈরি করে শিল্প কারখানায় গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিতে কাজ করছে, যার প্রভাবে উৎপাদন খরচ হ্রাস পাবে এবং স্থানীয়ভাবে সার উৎপাদন করা সম্ভব হবে।
কৃষকদের জন্য প্রত্যক্ষ সুফল
সরকারি এ ধরনের ক্রয় পরিকল্পনা শেষপর্যন্ত সরাসরি কৃষকদের জন্য সুফল বয়ে আনে। সময়মতো সার সরবরাহ নিশ্চিত হলে কৃষি উৎপাদনে বিঘ্ন ঘটে না এবং খাদ্য নিরাপত্তাও রক্ষা পায়।
এ ছাড়া সরকার নিয়মিতভাবে ভর্তুকি দিয়ে ইউরিয়ার দাম সাধারণ কৃষকের নাগালের মধ্যে রাখছে। বর্তমানে কৃষক পর্যায়ে ইউরিয়ার খুচরা মূল্য প্রতি কেজি ১৬ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
শিল্প মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, সরকার আগামীতে স্থানীয়ভাবে সার উৎপাদনকারী কারখানাগুলোকে আরও প্রযুক্তিনির্ভর করতে চায়। একই সঙ্গে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগকারীদের উৎসাহিত করা হচ্ছে যেন নতুন সার কারখানা স্থাপন করে চাহিদা পূরণে অংশগ্রহণ করে।
পরিকল্পনায় রয়েছে দেশের উত্তরাঞ্চলে একটি নতুন সার কারখানা নির্মাণের উদ্যোগ, যার মাধ্যমে সীমান্তবর্তী কৃষিজেলাগুলোর সার সরবরাহ সহজতর হবে।
উপসংহার
এই ক্রয় সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের সার ব্যবস্থাপনায় একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। কাফকোর সঙ্গে দীর্ঘদিনের সম্পর্ককে ধরে রেখে সরকারের এমন উদ্যোগ কৃষি ও শিল্প খাতের জন্য আশাব্যঞ্জক। একই সঙ্গে স্থানীয় উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ানোর উদ্যোগ দেশের সার নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার পথকে সুগম করবে।