বিশ্ব

পবিত্র হজের আনুষ্ঠানিকতা শুরু ৪ জুন

ইসলামের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ পবিত্র হজের মূল আনুষ্ঠানিকতা শুরু হচ্ছে ২০২৫ সালের ৪ জুন থেকে। সৌদি আরবের হজ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, ইতিমধ্যেই বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ১০ লাখেরও বেশি হজযাত্রী সৌদি আরবে পৌঁছেছেন এবং তাদের আগমন এখনো অব্যাহত রয়েছে। সৌদি সরকার এ বছর ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের জন্য হজ ব্যবস্থাপনাকে আরও সুসংগঠিত ও নিরাপদ করতে জোরদার প্রস্তুতি নিয়েছে।

হজ: ইসলামের পঞ্চম স্তম্ভ

হজ একটি ফরজ ইবাদত যা শারীরিক ও আর্থিকভাবে সামর্থ্যবান প্রত্যেক মুসলমানের জীবনে একবার আদায় করা আবশ্যক। এটি শুধু একটি ধর্মীয় অনুশীলনই নয়, বরং মুসলিম উম্মাহর ঐক্য, ভ্রাতৃত্ব ও আত্মত্যাগের প্রতীক। জিলহজ মাসের ৮ থেকে ১৩ তারিখ পর্যন্ত হজের মূল আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয়, যেখানে বিশ্বের লাখ লাখ মুসলমান একত্রিত হয়ে নির্দিষ্ট নিয়ম-কানুন অনুযায়ী এই ইবাদতে অংশগ্রহণ করেন।

আনুষ্ঠানিকতা শুরু ৪ জুন, আরাফাতের ময়দানে সমাবেশ ৫ জুন

চলতি বছর হজের প্রথম আনুষ্ঠানিকতা — মিনায় গমন ও সেখানে অবস্থান — শুরু হবে আগামী ৪ জুন, বুধবার। হজযাত্রীরা সেদিন মিনায় পৌঁছে রাতে সেখানে অবস্থান করবেন এবং পরদিন, অর্থাৎ ৫ জুন বৃহস্পতি বার, দ্বিতীয় দিনে তারা আরাফাতের ময়দানে জমায়েত হবেন। এই আরাফাত দিবসকেই হজের মূল দিন হিসেবে ধরা হয়। কারণ, পবিত্র হাদিসে বর্ণিত আছে, “হজ মানেই আরাফা।” অর্থাৎ, এই দিনটি ছাড়া হজ পূর্ণ হয় না।

বিদায় হজের ঐতিহাসিক স্মৃতি

আরাফাতের ময়দানে অবস্থিত জাবালে রহমত পাহাড়টি ইসলামী ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) এখানেই ১০ হিজরিতে তাঁর বিদায় হজে বিশ্বমানবতার প্রতি অসামান্য ভাষণ প্রদান করেন। সেই ভাষণ ছিল মানবাধিকার, নারীর সম্মান, দাসমুক্তি এবং আর্থ-সামাজিক সমতার এক অনন্য ঘোষণা। হজ পালন করতে এসে মুসলিমরা এই ঐতিহাসিক স্থান দর্শন ও নামাজ আদায়ের মাধ্যমে সেই গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তকে স্মরণ করেন।

মুযদালিফা ও মিনায় ফিরে কোরবানির প্রস্তুতি

৫ জুন সন্ধ্যায় আরাফাত থেকে মুযদালিফায় গমন করবেন হাজিরা, যেখানে তারা রাতভর অবস্থান করে মাগরিব ও এশার নামাজ আদায় করবেন এবং মাটিতে ঘুমিয়ে রাত কাটাবেন। এরপর ৬ জুন সকালবেলা মিনায় ফিরে তারা শয়তানকে পাথর নিক্ষেপ, পশু কোরবানি এবং মাথা মুন্ডনের মাধ্যমে ঈদুল আজহার দিনটি পালন করবেন।

এ বছর সৌদি আরবে ঈদুল আজহা উদযাপিত হবে ৬ জুন, শুক্রবার। একই দিনে বিশ্বজুড়েও ঈদ উদযাপিত হবে, যদিও কিছু দেশে চাঁদ দেখার ওপর ভিত্তি করে তারিখ একদিন এদিক-ওদিক হতে পারে।

নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় জোর

সৌদি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, হজযাত্রীদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে বিভিন্ন স্থানে স্থাপন করা হয়েছে মোবাইল ক্লিনিক, অস্থায়ী হাসপাতাল এবং বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের ব্যবস্থা। করোনাভাইরাস পরবর্তী বাস্তবতায় স্বাস্থ্যবিধি ও ভিড় নিয়ন্ত্রণে বিশেষ নজর দেওয়া হয়েছে। এ বছর শতাধিক ভাষায় দিকনির্দেশনামূলক সাইনবোর্ড, অ্যাপ এবং ইলেকট্রনিক ব্যবস্থার মাধ্যমে হজযাত্রীদের সহায়তা প্রদান করা হচ্ছে।

প্রযুক্তির ব্যবহার ও হজ ব্যবস্থাপনা

চলতি বছর হজ ব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের প্রযুক্তিগত উন্নয়ন এনেছে সৌদি আরব। হাজিদের চলাচল, অবস্থান ও স্বাস্থ্য পর্যবেক্ষণে ব্যবহার করা হচ্ছে বিশেষ স্মার্ট আইডি কার্ড ও মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন। হজের প্রতিটি ধাপে হাজিরা যাতে বিভ্রান্ত না হন, সে জন্য নিযুক্ত করা হয়েছে হাজার হাজার স্বেচ্ছাসেবক এবং দ্বিভাষিক গাইড।

বাংলাদেশের প্রস্তুতি

বাংলাদেশ থেকে এ বছর প্রায় ৮০ হাজার হজযাত্রী পবিত্র হজে অংশ নিচ্ছেন বলে জানিয়েছে ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়। সরকারি ও বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় হজযাত্রীরা ইতোমধ্যে সৌদি আরব পৌঁছেছেন। ধর্ম প্রতিমন্ত্রী জানিয়েছেন, বাংলাদেশি হজযাত্রীদের জন্য মক্কা ও মদিনায় আবাসন, খাবার এবং যাতায়াতের ব্যবস্থা আগেভাগেই নিশ্চিত করা হয়েছে। হজ মিশনের কর্মকর্তারা মক্কা ও মদিনায় হাজিদের সার্বক্ষণিক সহায়তা প্রদান করছেন।

হজের তাৎপর্য ও শিক্ষা

হজ শুধুমাত্র একটি ধর্মীয় আচার নয়, এটি মানুষের আত্মিক পরিশুদ্ধি, ধৈর্য, ত্যাগ ও সহনশীলতার এক মহাপাঠ। লাখো মানুষের এই মিলনমেলা মুসলিমদের একতাবদ্ধ থাকার বার্তা দেয়। বৈষম্যহীন এই জমায়েতে রাজা-প্রজা, ধনী-গরিব, কৃষক-শ্রমিক — সবাই একই সাদা কাপড়ে আবৃত হয়ে এক সারিতে দাঁড়ায়। এই চিত্র ইসলামের সাম্যের দর্শনকে প্রতিফলিত করে।

সার্বিক ব্যবস্থাপনায় সৌদি সরকারের প্রশংসা

বিশ্বব্যাপী কোটি কোটি মুসলমান সৌদি আরব সরকারের হজ ব্যবস্থাপনার প্রশংসা করেছেন। প্রতিবারের মতো এবারও যাত্রীদের নিরাপত্তা, ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা এবং খাদ্য-আবাসনের সার্বিক ব্যবস্থাপনায় তারা অতুলনীয় নিষ্ঠা ও আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার করেছে।

হজের এই বিশাল কর্মযজ্ঞ শুধু মুসলমানদের নয়, গোটা বিশ্বের জন্য এক অসাধারণ নজির। বিশ্ব যখন বিভাজনের দিকে যাচ্ছে, তখন হজ মুসলমানদের ঐক্য, সংহতি এবং আল্লাহর পথে আত্মসমর্পণের এক গৌরবোজ্জ্বল নিদর্শন হিসেবে মানবজাতিকে অনুপ্রাণিত করে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button