বানিজ্য

মার্কিন-চীন শুল্কযুদ্ধে লাভবান হতে পারে বাংলাদেশ: জার্মান কোম্পানিগুলোর নজর এখন ঢাকায়

বিশ্ব রাজনীতিতে চলমান উত্তেজনা ও বাণিজ্যিক অস্থিরতার মাঝে বাংলাদেশ নতুন করে আকর্ষণীয় গন্তব্য হয়ে উঠছে জার্মান বিনিয়োগকারীদের কাছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের চীনের পণ্যের ওপর ধারাবাহিক শুল্ক বাড়ানো এবং সম্প্রতি বাংলাদেশের ওপর নতুন করে ৩৭ শতাংশ আমদানি শুল্ক আরোপের ফলে সৃষ্ট নতুন বাস্তবতায় নিজেদের জন্য সুযোগ দেখছে ইউরোপের অন্যতম অর্থনৈতিক শক্তি জার্মানি।

চলতি এপ্রিল মাসে একটি উচ্চপর্যায়ের জার্মান ব্যবসায়ী প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ সফর করে। সফরের মূল লক্ষ্য ছিল—বাংলাদেশের বিনিয়োগ পরিবেশ, উৎপাদন সক্ষমতা ও অর্থনৈতিক সংস্কার পর্যবেক্ষণ এবং সম্ভাব্য শিল্পখাতে বিনিয়োগের সুযোগ যাচাই। এ প্রতিনিধি দলে ছিলেন জার্মান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, অর্থ মন্ত্রণালয়, জার্মান রপ্তানি ঋণ সংস্থা এবং আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তা ও ব্যবসায়িক নেতৃবৃন্দ।

‘উদীয়মান বাজার’ হিসেবে বাংলাদেশের প্রতি আগ্রহ

জার্মান পোশাক প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান অস্পিগ জিএমবিএইচ-এর প্রধান নির্বাহী থমাস ক্যোনিং প্রতিনিধিদলের সদস্য হিসেবে ঢাকা সফর করেন। তিনি বলেন, ‘উদীয়মান বাজার হিসেবে বাংলাদেশের সম্ভাবনা অনেক। বিনিয়োগকারীদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক সূচক ও পরিকাঠামো উন্নয়নের ধারাও আশাব্যঞ্জক।’

উল্লেখ্য, অস্পিগ বর্তমানে বাংলাদেশে কয়েক হাজার শ্রমিক নিয়োগ দিয়ে জিনস ও জ্যাকেট উৎপাদন করছে।

দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য: একটি শক্ত ভিত্তি

বাংলাদেশ ও জার্মানির মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। ২০২৩ সালে দুই দেশের মধ্যে মোট বাণিজ্য হয়েছে ৮.৬ বিলিয়ন ইউরো, অর্থাৎ প্রায় ৯.৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এর মধ্যে বাংলাদেশ থেকে জার্মানিতে রপ্তানি হয়েছে মূলত পোশাক খাতভিত্তিক পণ্য, যার পরিমাণ ছিল মোট রপ্তানির ৯০ শতাংশেরও বেশি। অন্যদিকে, বাংলাদেশ জার্মানি থেকে আমদানি করেছে যন্ত্রপাতি, বৈদ্যুতিক সামগ্রী এবং রাসায়নিক পণ্য।

বর্তমানে বাংলাদেশে কার্যক্রম পরিচালনা করছে অন্তত ৮০টি জার্মান কোম্পানি, যার মধ্যে রয়েছে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় ব্র্যান্ড বাসফ, বায়ার, সিমেন্স এবং বশ। এছাড়া হানা সিস্টেম লিমিটেড নামের একটি কোম্পানি মেঘনা গ্রুপের সহযোগিতায় কিউব তৈরি করছে, যা একটি যৌথ উদ্যোগ।

চীনের বিকল্প উৎপাদন কেন্দ্র হিসেবে বাংলাদেশের সম্ভাবনা

মার্কিন-চীন বাণিজ্যযুদ্ধ জার্মান বিনিয়োগকারীদের নতুন দিক ভাবতে বাধ্য করেছে। ক্যোনিং বলেন, ‘ভূরাজনৈতিক অস্থিরতা ও মার্কিন শুল্ক বৃদ্ধির ফলে জার্মান কোম্পানিগুলো বিকল্প উৎপাদন কেন্দ্র খুঁজছে। বাংলাদেশে বৈচিত্র্যপূর্ণ খাত যেমন ইলেকট্রনিকস, হোম অ্যাপ্লায়েন্স, এবং ভোগ্যপণ্যে বিনিয়োগের সম্ভাবনা রয়েছে।’

এই ধারণাকে সমর্থন করে বাংলাদেশি থিংক ট্যাংক Policy Exchange Bangladesh-এর প্রধান অর্থনীতিবিদ মাসরুর রিয়াজ বলেন, ‘এটি আমাদের জন্য এক প্রজন্মে একবার আসা সুযোগ। সরকার যদি দ্রুত সংস্কার ও উৎপাদন দক্ষতা বৃদ্ধি করে, তবে বাংলাদেশ আগামী দশকে এশিয়ার অন্যতম শিল্প উৎপাদন কেন্দ্র হয়ে উঠতে পারে।’

বিদ্যমান চ্যালেঞ্জ: বিদ্যুৎ ও দুর্নীতি

তবে বিনিয়োগকারীদের আগ্রহের পাশাপাশি রয়েছে কিছু সতর্কবার্তাও। বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে বিনিয়োগের বড় বাধাগুলোর মধ্যে রয়েছে—

  • বিদ্যুৎসংকট
  • অর্থায়নের সীমিত সুযোগ
  • দুর্নীতি

এছাড়া রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং প্রশাসনিক জটিলতাও একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে পারে। ওএভির নির্বাহী বোর্ড সদস্য আলমুট রোসনার বলেন, ‘আমরা এসব চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে অবগত আছি। তবে বর্তমান সরকার পরিস্থিতি স্থিতিশীল রাখতে কাজ করছে।’

রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ও সংস্কার উদ্যোগ

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন। তিনি আগামী বছরের জুনের মধ্যে নির্বাচন আয়োজন ও গণতান্ত্রিক সংস্কার বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরাতে এই রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।

যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানির বর্তমান পরিস্থিতি

২০২৪ সালে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করেছে ৮.৪ বিলিয়ন ডলারের পণ্য। এর মধ্যে ৭.৩৪ বিলিয়ন ডলার এসেছে শুধু তৈরি পোশাক খাত থেকে। কিন্তু ট্রাম্প প্রশাসনের নতুন শুল্কনীতির ফলে এই রপ্তানিতে ধস নামতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। যদিও ৯০ দিনের একটি শুল্ক ছাড় দেওয়া হয়েছে, তবে অর্ডার বাতিল, নতুন চুক্তি অনিশ্চিত হওয়া, এবং রপ্তানির সময়কাল দীর্ঘায়িত হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।

এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ নতুন বাজার ও নতুন বিনিয়োগ উৎসের দিকে নজর দিচ্ছে, যার মধ্যে জার্মানি অন্যতম।

সমাপনী মন্তব্য

বাংলাদেশের জন্য এটি একটি ‘উইন্ডো অব অপরচুনিটি’। জার্মান কোম্পানিগুলো যদি সত্যি বাংলাদেশকে তাদের পরবর্তী উৎপাদন কেন্দ্র হিসেবে গ্রহণ করে, তবে দেশের অর্থনীতি একটি নতুন যুগে প্রবেশ করতে পারে। তবে এজন্য প্রয়োজন—

  • নীতিগত স্থিতিশীলতা
  • অবকাঠামোগত উন্নয়ন
  • দক্ষ মানবসম্পদ
  • দুর্নীতি হ্রাস

বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতা দিন দিন তীব্র হচ্ছে। এই মুহূর্তে কৌশলগত সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাধ্যমেই বাংলাদেশ তার শিল্প, রপ্তানি এবং কর্মসংস্থানের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করতে পারবে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button