উত্তাল সাগরে চট্টগ্রামের উপকূলে কয়লাবাহী বার্জ ও দুটি লাইটার জাহাজ আটকে পড়েছে

চট্টগ্রাম উপকূলজুড়ে চলমান দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার প্রভাবে সৃষ্ট উত্তাল ঢেউয়ের তোড়ে একটি কয়লাবাহী বার্জ ও দুটি লাইটার জাহাজ তীরে এসে আটকে গেছে। বৃহস্পতিবার (২৯ মে) রাত থেকে শুক্রবার দুপুর পর্যন্ত আনোয়ারা ও পতেঙ্গা উপকূলীয় অঞ্চলের তিনটি পৃথক স্থানে এসব জলযান আটকে পড়ার ঘটনা ঘটে।
নৌযান আটকে পড়ার ঘটনায় উদ্বেগ ছড়িয়েছে স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে। একইসাথে এসব জাহাজের নিরাপত্তা ও পরিবেশগত সম্ভাব্য ক্ষতির বিষয়টিও সামনে চলে এসেছে।
আনোয়ারায় কয়লাবাহী বার্জ আটকে যায় রাতে
আনোয়ারা থানার ওসি মনির হোসেন জানিয়েছেন, বৃহস্পতিবার রাতে একটি কয়লাবাহী বার্জ আনোয়ারা উপজেলার গহিরা উপকূলে এসে আটকে যায়। তবে বার্জটিতে সেই সময় কোনো কয়লা ছিল না, অর্থাৎ এটি খালি ছিল।
ওসি বলেন, “আবহাওয়া খারাপ থাকায় জাহাজটি সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে তীরে উঠে যায়। এখন এটি উপকূলেই আটকে রয়েছে।”
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, বার্জটি কোনো একটি বিদ্যুৎকেন্দ্রে কয়লা সরবরাহে ব্যবহৃত হতো এবং খালি অবস্থায় ঘাটে ফেরার সময় এটি ঢেউয়ের তোড়ে গহিরা উপকূলে চলে আসে।
পতেঙ্গায় আরও দুটি লাইটার জাহাজ আটকে পড়ে
শুক্রবার বেলা ১১টার দিকে পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতের চরপাড়া এলাকায় দুটি লাইটার জাহাজ – এলপিজি সোফিয়া ও এমভি আল হেরান – তীরে এসে আটকে যায়। আবহাওয়ার বিরূপ পরিস্থিতি এবং উত্তাল সাগরের কারণে এসব জাহাজও নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে তীরে চলে আসে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে।
জাহাজ দুটি সৈকতে আটকে পড়ার খবরে শত শত উৎসুক মানুষ সেখানে ভিড় করে। স্থানীয় ব্যবসায়ী ও পর্যটকদের মধ্যে কৌতূহল দেখা দেয়, যদিও প্রশাসনের পক্ষ থেকে সর্তকতা অবলম্বন করতে বলা হয়েছে।
স্থানীয়দের অভিজ্ঞতা ও প্রতিক্রিয়া
আনোয়ারার বাসিন্দা ও ব্যাংক কর্মকর্তা আজাদ মঈনুদ্দীন জানান,
“সকালেই খবর পাই উপকূলে একটি বড় জাহাজ আটকে গেছে। দেখতে এসেছি। এরকম ঘটনা এখানে নতুন নয়, আগেও ঘূর্ণিঝড় বা নিম্নচাপের সময় বড় জাহাজ তীরে এসে আটকে পড়েছে।”
পতেঙ্গার স্থানীয়দের অনেকেই বলছেন, এসব জলযান তীরে উঠে এলে আশেপাশের জীববৈচিত্র্যে ক্ষতি হয় এবং পর্যটকদের চলাচলেও বিঘ্ন ঘটে।
দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার প্রভাব
চট্টগ্রাম উপকূলজুড়ে গত কয়েকদিন ধরেই মেঘলা আকাশ, ভারি বৃষ্টি ও দমকা হাওয়া লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আবহাওয়া অফিস ইতোমধ্যে সমুদ্রবন্দরগুলোকে ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত দেখাতে বলেছে।
দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে চট্টগ্রাম থেকে হাতিয়া ও সন্দ্বীপগামী সব যাত্রীবাহী ও পণ্যবাহী নৌযান চলাচল সাময়িকভাবে বন্ধ রাখা হয়েছে। এমনকি সন্দ্বীপের স্পিডবোট চলাচলও বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
পরিবেশগত ঝুঁকি নিয়ে আশঙ্কা
পরিবেশবাদীরা বলছেন, উপকূলে ভারী জলযান আটকে গেলে তা সমুদ্রতীরবর্তী জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশে ক্ষতির সম্ভাবনা তৈরি করে। বিশেষ করে যদি এসব জাহাজে জ্বালানি তেল, রাসায়নিক বা অন্যান্য বিপজ্জনক পদার্থ থাকে, তবে তা তেল ছড়িয়ে পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কা তৈরি করতে পারে।
তবে এবার যেহেতু কয়লাবাহী বার্জটি খালি ছিল এবং অপর দুটি জাহাজও এলপিজি পরিবহনের হলেও এখন পর্যন্ত কোনো ধরনের তেল বা গ্যাস লিকেজের খবর পাওয়া যায়নি, তাই আপাতত বড় কোনো ঝুঁকি তৈরি হয়নি বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্টরা।
উদ্ধার তৎপরতা কীভাবে চলছে?
বন্দরের নিরাপত্তা ও উদ্ধার-সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে,
“জাহাজ তিনটি যে অবস্থানে রয়েছে, সেগুলো উদ্ধার করতে হয়তো টাগবোট (Tugboat) বা ক্রেন ব্যবহার করতে হবে। আবহাওয়া স্বাভাবিক হলে এবং জোয়ারের সময় এসব জাহাজ টেনে নিরাপদ স্থানে নেয়া সম্ভব হতে পারে।”
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ (CPA) এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে এ বিষয়ে বিবৃতি দেয়নি, তবে সমুদ্র উত্তাল থাকায় তারা সতর্ক অবস্থানে রয়েছে বলে জানা গেছে।
অতীতেও এমন ঘটনা ঘটেছে
চট্টগ্রামের আনোয়ারা, পতেঙ্গা বা বাঁশখালী উপকূলে অতীতেও এমন জাহাজ আটকে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। বিশেষ করে ২০২১ সালে ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের সময় একটি কয়লাবাহী জাহাজ আনোয়ারা উপকূলে আটকে যায় এবং পরে সেটি সরাতে কয়েকদিন সময় লাগে।
জাহাজ চলাচলের জন্য এসব উপকূলীয় অঞ্চল ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে যখন সঠিক আবহাওয়া বার্তা অনুসরণ না করে জাহাজ চালানো হয় কিংবা খালি জাহাজগুলো উপকূলের কাছে অবস্থান করে।
চট্টগ্রামের আনোয়ারা ও পতেঙ্গা উপকূলে কয়লাবাহী বার্জ ও দুটি লাইটার জাহাজ আটকে যাওয়ার ঘটনা আবারও প্রমাণ করে দেয়, উপকূলীয় অঞ্চলে জলযান চলাচলে অতিরিক্ত সতর্কতা প্রয়োজন।
সরকার ও বন্দরের পক্ষ থেকে দ্রুত উদ্ধার কার্যক্রম শুরু এবং পরিবেশগত ঝুঁকি মূল্যায়ন করা এখন সময়ের দাবি।
উত্তাল সাগরে জাহাজ আটকে পড়া নিছক দুর্ঘটনা হলেও, এর প্রতিক্রিয়া হতে পারে দীর্ঘস্থায়ী—পরিবেশ, নিরাপত্তা এবং আর্থিক খাত—সবকিছুতেই।