বানিজ্য

মাতারবাড়ীতে হবে ‘ফ্রি ট্রেড জোন’: বিডা চেয়ারম্যান

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে আরও গতিশীল করতে এবং বৈশ্বিক বাণিজ্য সংযোগকে আরও শক্তিশালী করতে কক্সবাজারের মহেশখালীর মাতারবাড়ী এলাকায় একটি ‘ফ্রি ট্রেড জোন’ বা মুক্ত বাণিজ্য এলাকা গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা)। এই কার্যক্রমে অংশ নিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে মধ্যপ্রাচ্যের খ্যাতনামা পোর্ট অপারেটর কোম্পানি ডিপি ওয়ার্ল্ড, যারা সংযুক্ত আরব আমিরাতের জেবেল আলি বন্দরের আশেপাশে সফলভাবে একটি ফ্রি ট্রেড জোন পরিচালনা করছে।

বুধবার (৯ এপ্রিল) ঢাকায় অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ বিনিয়োগ সম্মেলনের তৃতীয় দিনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন এই পরিকল্পনার বিস্তারিত তুলে ধরেন।


মাতারবাড়ীকে ঘিরে নতুন অর্থনৈতিক জোন

চৌধুরী আশিক মাহমুদ বলেন, “আমরা মহেশখালী ও মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দরকে ঘিরে একটি ফ্রি ট্রেড জোন গড়ে তোলার পরিকল্পনা করছি। এই উদ্যোগ বাস্তবায়নে আমরা ডিপি ওয়ার্ল্ডের সহযোগিতা চাইছি। তারা কারিগরি ও কৌশলগত দিক থেকে আমাদের সহায়তা করতে চায়।”

ডিপি ওয়ার্ল্ডের চেয়ারম্যান সুলতান আহমেদ বিন সুলায়েম বাংলাদেশ বিনিয়োগ সম্মেলনে অংশ নিতে এদিন ঢাকা সফরে আসেন। বিডা চেয়ারম্যান জানান, “আজকে ডিপি ওয়ার্ল্ডের চেয়ারম্যানের মূল উদ্দেশ্যই ছিল বাংলাদেশে এই ধরনের অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার সম্ভাবনা যাচাই করা। খুব শিগগিরই বাংলাদেশ থেকে একটি প্রতিনিধি দল সংযুক্ত আরব আমিরাত সফরে যাবে, যেখানে তারা জেবেল আলি বন্দরের ফ্রি ট্রেড জোনের কার্যক্রম ঘুরে দেখবে।”


জেবেল আলি মডেল: বাংলাদেশের জন্য অনুপ্রেরণা

সংযুক্ত আরব আমিরাতের অর্থনীতির প্রায় ২৫ শতাংশ অবদান রাখে জেবেল আলি বন্দর ও তার আশেপাশের ফ্রি ট্রেড জোন। বিডা মনে করে, মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দরকে ঘিরেও তেমনি একটি শক্তিশালী অর্থনৈতিক হাব গড়ে তোলা সম্ভব, যা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের কেন্দ্র হয়ে উঠতে পারে।

বিডা চেয়ারম্যান বলেন, “মাতারবাড়ীতে ফ্রি ট্রেড জোন প্রতিষ্ঠা করা হলে একদিকে যেমন বিদেশি বিনিয়োগ আসবে, তেমনি দেশের শিল্পায়ন ও কর্মসংস্থানেও নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে।”


বৈদেশিক বিনিয়োগে আগ্রহী আন্তর্জাতিক কোম্পানিগুলো

বিনিয়োগ সম্মেলনের তৃতীয় দিনটিতে শুধুমাত্র ডিপি ওয়ার্ল্ড নয়, বরং আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক কোম্পানির অংশগ্রহণে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বিডা চেয়ারম্যান জানান, “আজকে ইন্ডিটেক্সের (Zara-এর মূল প্রতিষ্ঠান) সিইও প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ সফর করেছেন। তিনি বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশে না এলে এই দেশ সম্পর্কে অনেক কিছুই অজানা থেকে যেত।’”

এছাড়া LafargeHolcim-এর সঙ্গেও বিনিয়োগ নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হয়েছে। যুক্তরাজ্যের ট্রেড টিম বাংলাদেশ সরকারের ভিশন ২০৩৫ সম্পর্কে শুনে শিক্ষাখাত ও স্বাস্থ্যখাতে বিনিয়োগে আগ্রহ প্রকাশ করেছে।


বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরিতে সরকার বদ্ধপরিকর

চৌধুরী আশিক মাহমুদ জানান, সম্মেলনের সময় একাধিক দ্বিপক্ষীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে বাণিজ্য উপদেষ্টা, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, এনবিআর চেয়ারম্যানসহ সরকারের শীর্ষ কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। এই বৈঠকগুলোর মাধ্যমে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের চাহিদা বুঝে, তাদের জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ ৩৬০ ডিগ্রি দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরা হয়।

তিনি আরও বলেন, “বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে আলোচনা করে বুঝতে পেরেছি, তারা বাংলাদেশে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ করতে চায়। তবে এর জন্য অবকাঠামো, নীতিগত স্থিতিশীলতা এবং দক্ষ মানবসম্পদের ওপর জোর দিতে হবে।”


তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য বিশেষ উদ্যোগ

এই দিনেই ইউএনডিপি ও গ্রামীণফোনের সহায়তায় তরুণ উদ্যোক্তাদের নিয়ে একটি বিশেষ অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে বাংলাদেশের নোবেল বিজয়ী ও প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস উপস্থিত ছিলেন। তরুণদের সঙ্গে মতবিনিময়ের পাশাপাশি তিনি ভবিষ্যত ব্যবসায়িক সম্ভাবনা নিয়েও আলোচনা করেন।


ফ্রি ট্রেড জোন: কেবল অর্থনৈতিক নয়, কৌশলগত উদ্যোগও

বিশেষজ্ঞদের মতে, মাতারবাড়ীকে ঘিরে ফ্রি ট্রেড জোন প্রতিষ্ঠা হলে শুধু অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিই নয়, বরং এটি কৌশলগত দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ হবে। কারণ গভীর সমুদ্রবন্দর ও অর্থনৈতিক অঞ্চল একত্রে কাজ করলে তা বৈশ্বিক লজিস্টিক নেটওয়ার্কের একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হয়ে উঠতে পারে।

বাংলাদেশ ইতোমধ্যে একাধিক অর্থনৈতিক অঞ্চল ও ইপিজেড গড়ে তুলেছে। তবে ফ্রি ট্রেড জোনের ধারণা তুলনামূলক নতুন হলেও, এর সফল বাস্তবায়ন হলে তা দেশের অর্থনীতিকে বহুগুণে এগিয়ে নেবে।


উপসংহার

বাংলাদেশ দ্রুত শিল্পোন্নয়ন ও বৈদেশিক বিনিয়োগে অগ্রগামী এক অর্থনীতি হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলছে। মাতারবাড়ীকে ঘিরে ফ্রি ট্রেড জোন গড়ে তোলার এই উদ্যোগ সেই অভিযাত্রাকে আরও বেগবান করবে। আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ, সরকারের পরিকল্পনা এবং যৌথ সহযোগিতার মাধ্যমে এই প্রকল্প সফল হলে তা শুধু মাতারবাড়ী নয়, পুরো দেশের অর্থনীতির জন্য হবে এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button