বানিজ্য

নতুন উদ্যোক্তাদের সহায়তায় ৯০০ কোটি টাকার তহবিল আসছে

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির এক নতুন অধ্যায়ে প্রবেশ করতে যাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। স্টার্টআপ খাতের নবীন উদ্যোক্তাদের সহায়তায় প্রায় ৮০০ থেকে ৯০০ কোটি টাকার বিশেষ একটি তহবিল গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সোমবার (৭ এপ্রিল) অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ বিনিয়োগ সম্মেলনের ‘স্টার্টআপ কানেক্ট’ অধিবেশনের আলোচনায় এই ঘোষণা দেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর।

এই পদক্ষেপকে অনেকেই উদ্যোক্তা উন্নয়নে একটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত হিসেবে দেখছেন। কেননা, দীর্ঘদিন ধরে দেশের তরুণ উদ্যোক্তারা মূলধনের অভাবে নিজেদের উদ্ভাবনী ধারণাগুলো বাস্তব রূপ দিতে পারছিলেন না। এমন একটি তহবিল তাদের পথচলায় গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

অর্থায়নের কাঠামো ও বাস্তবায়ন পদ্ধতি

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর জানান, এই তহবিলটি পরিচালিত হবে দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে। তারা নির্দিষ্ট কিছু মানদণ্ডের ভিত্তিতে স্টার্টআপ কোম্পানিগুলোকে মূলধন সরবরাহ করবে। তিনি বলেন, “শিগগিরই এই বিষয়ে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করা হবে, যেখানে তহবিল ব্যবস্থাপনা ও বিতরণ সম্পর্কিত বিস্তারিত নির্দেশনা থাকবে।”

তিনি আরও যোগ করেন, “এই তহবিলের মাধ্যমে আমরা চাই দেশের মেধাবী তরুণ উদ্যোক্তারা তাদের ব্যবসায়িক ধারণাকে বাস্তবে রূপ দিতে পারুক। তাদের সহায়তায় ব্যাংকিং খাত এবং সরকারি প্রশাসনের সমন্বিত সহায়তা নিশ্চিত করা হবে।”

ধৈর্য ও অধ্যবসায়ের ওপর গুরুত্ব

প্যানেল আলোচনায় অংশ নিয়ে গভর্নর আহসান এইচ মনসুর উদ্যোক্তাদের উদ্দেশে বলেন, “স্টার্টআপগুলোর লাভ এক দিনেই আসে না। আপনাকে ধৈর্য ধরতে হবে, আপনাকে অধ্যবসায় করতে হবে।” তিনি তরুণ উদ্যোক্তাদের প্রতি আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, “আমি বিকাশের মতো আরও কয়েকটি ইউনিকর্ন দেখতে চাই। আমাদের দেশেও সেই সম্ভাবনা আছে।”

তিনি বলেন, “বিকাশ একটি উদাহরণ হয়ে দাঁড়িয়েছে—যেখানে সঠিক সহায়তা, প্রযুক্তি এবং সময়োপযোগী সিদ্ধান্তের মাধ্যমে একটি উদ্যোগ আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিতি লাভ করেছে। সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে আমরা আরও ইউনিকর্ন তৈরি করতে পারি।”

ব্যবসায়িক পরিবেশের চ্যালেঞ্জ ও বিডার ভূমিকা

সম্মেলনে বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরী বলেন, “বর্তমানে নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য ব্যবসা শুরু করতে গেলে অনেক প্রশাসনিক জটিলতার মুখে পড়তে হয়। বিশেষ করে ট্রেড লাইসেন্স নবায়নের ক্ষেত্রে প্রতিবছর ভোগান্তি পোহাতে হয় ব্যবসায়ীদের।” তিনি সরকারি প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানান, যাতে লাইসেন্স সংক্রান্ত লালফিতা ও بير bureaucratic বাধাগুলো কমিয়ে উদ্যোক্তা বান্ধব পরিবেশ গড়ে তোলা যায়।

চৌধুরী বলেন, “আমরা চাই একটি এমন ইকোসিস্টেম, যেখানে নতুন উদ্যোক্তারা নির্ভয়ে ব্যবসা শুরু করতে পারেন এবং প্রয়োজনীয় সহযোগিতা পান—ব্যাংক থেকে লাইসেন্স সংক্রান্ত দপ্তর পর্যন্ত।”

আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গি ও ভবিষ্যৎ প্রত্যাশা

এই আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ সম্মেলনের অংশ হিসেবে ‘স্টার্টআপ কানেক্ট’ অধিবেশনে দেশি-বিদেশি তরুণ উদ্যোক্তা, বিনিয়োগকারী ও নীতি-নির্ধারকরা অংশ নেন। ভার্চ্যুয়াল মাধ্যমে অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন লিংকডইনের সহ-প্রতিষ্ঠাতা রিড হফম্যান। তিনি বাংলাদেশের তরুণদের প্রযুক্তিনির্ভর ও উদ্ভাবনী চিন্তাধারার প্রশংসা করেন এবং বলেন, “উদ্যোক্তা উন্নয়নে সমন্বিত পদক্ষেপ থাকলে বাংলাদেশও প্রযুক্তি খাতে বৈশ্বিক অবস্থান নিতে পারবে।”

মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন কানাডা প্রবাসী ও কনস্টিলেশন অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানির চেয়ারম্যান তানভীর আলী। তিনি বাংলাদেশের তরুণ জনগোষ্ঠীর বিপুল সম্ভাবনার কথা তুলে ধরেন এবং বলেন, “এই জনসংখ্যা আমাদের দেশের সবচেয়ে বড় শক্তি হতে পারে, যদি তাদের সঠিক পথে পরিচালিত করা যায়।”

সরকারি-স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণ

প্যানেল আলোচনায় আরও উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর আইসিটি-বিষয়ক উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমেদ তৈয়্যব, আইসিটি সচিব শীশ হায়দার চৌধুরী, বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) কর্মকর্তা ও স্টার্টআপ পলিসি নির্ধারকরা। তারা সবাই উদ্যোক্তাবান্ধব নীতি প্রণয়নে ঐক্যমত্য পোষণ করেন এবং আশ্বাস দেন, সরকারি পর্যায় থেকে বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা দূর করতে নিরবচ্ছিন্ন কাজ চলবে।

সম্মেলনের মূল উদ্দেশ্য ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা

এই চার দিনব্যাপী সম্মেলনের মূল প্রতিপাদ্য ছিল ‘এম্পাওয়ারিং ইনোভেশন, কানেকটিং অপরচুনিটি’। এটি মূলত দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের মধ্যে সংযোগ স্থাপন এবং উদ্ভাবনকে কেন্দ্র করে একটি দীর্ঘমেয়াদি কর্মপরিকল্পনা প্রণয়নের উদ্দেশ্যে আয়োজন করা হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এই বিশেষ তহবিলের ঘোষণা সম্মেলনের আলোচনাগুলোতে এক নতুন গতি আনে এবং উদ্যোক্তা সমাজে নতুন আশার সঞ্চার করে। স্টার্টআপ পরিবেশে সঠিক আর্থিক সহায়তা নিশ্চিত হলে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি, প্রযুক্তি বিকাশ এবং অর্থনীতির বহুমাত্রিক উন্নয়ন হবে বলেই আশা করা যায়।

উপসংহার

বাংলাদেশে স্টার্টআপ ইকোসিস্টেম গঠনের ক্ষেত্রে ৯০০ কোটি টাকার এই তহবিল নিঃসন্দেহে একটি মাইলফলক পদক্ষেপ। এটি শুধু উদ্যোক্তাদের আর্থিক সহায়তা নয়, বরং দেশের অর্থনীতিকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য প্রস্তুত করার একটি কৌশলগত পদক্ষেপ। সরকার, ব্যাংকিং খাত এবং উদ্যোক্তা সমাজের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এ উদ্যোগ বাস্তবায়িত হলে, আগামী দশকে বাংলাদেশ প্রযুক্তিনির্ভর উন্নয়নের এক নতুন অধ্যায়ে প্রবেশ করবে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button