সৌরবিদ্যুতের ব্যবসায় আসছে প্রাণ-আরএফএল

দেশের অন্যতম বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠী প্রাণ–আরএফএল গ্রুপ এবার নবায়নযোগ্য জ্বালানির খাতে পা রাখতে যাচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটি মৌলভীবাজার জেলার একটি সমন্বিত কৃষি খামারে ১০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রকল্প শুরু করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে উৎপাদিত বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হবে দেশের বিভিন্ন পোশাক রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানকে, যারা সুইডেনভিত্তিক খ্যাতনামা ব্র্যান্ড এইচঅ্যান্ডএম (H&M)-এর জন্য পণ্য তৈরি করে।
এই প্রকল্পের জন্য অর্থায়ন করবে বিশ্বব্যাংক গ্রুপের সহায়ক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স করপোরেশন (আইএফসি)। এ লক্ষ্যে আগামী বুধবার ঢাকায় চলমান আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ সম্মেলনের তৃতীয় দিনে প্রাণ–আরএফএল, এইচঅ্যান্ডএম এবং আইএফসির মধ্যে একটি ত্রিপক্ষীয় সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার কথা রয়েছে।
নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিকে পদক্ষেপ
জানা গেছে, প্রাণ–আরএফএল গ্রুপের মালিকানাধীন মৌলভীবাজারের সমন্বিত কৃষি খামারে প্রায় ৩৫০ একর জমি রয়েছে। এই বিশাল জায়গাজুড়ে সৌর প্যানেল স্থাপন করে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এই বিদ্যুৎ মূলত এমন পোশাক উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে বিক্রি করা হবে, যারা পরিবেশবান্ধব উৎপাদনের ওপর গুরুত্বারোপ করে এবং বিদেশি ক্রেতাদের বিশেষত ইউরোপীয় ব্র্যান্ডগুলোর কাছে টেকসই সরবরাহ ব্যবস্থার প্রতিশ্রুতি দেয়।
বিশ্বজুড়ে পোশাক খাতের ক্রেতারা এখন টেকসই উৎপাদন ও কম কার্বন নির্গমন নিশ্চিতে জোর দিচ্ছেন। বিশেষ করে এইচঅ্যান্ডএম তাদের সরবরাহ চেইনে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বাড়াতে আগ্রহী। সেই সুযোগ কাজে লাগাতে চায় প্রাণ–আরএফএল গ্রুপ।
নীতিমালার অভাব ও ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ
যদিও এই প্রকল্প বাংলাদেশের নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে একটি বড় পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে, তবু দেশের বিদ্যুৎ ক্রয়-বিক্রয় ও বিতরণ সংক্রান্ত কোনো নির্দিষ্ট নীতিমালা এখনো কার্যকরভাবে বিদ্যমান নেই। ফলে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা দ্রুত একটি সুস্পষ্ট নীতিমালা প্রণয়নের তাগিদ দিয়েছেন।
এ বিষয়ে প্রাণ–আরএফএল গ্রুপের চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) আহসান খান চৌধুরী বলেন, “আমরা প্রাথমিকভাবে ১০০ মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা করছি। তবে এটি কার্যকর করতে হলে সরকারের নীতিগত সহায়তা প্রয়োজন। নীতিগত কাঠামো যত দ্রুত তৈরি হবে, আমরা তত দ্রুত কাজ শুরু করতে পারব।”
তিনি আরও জানান, প্রকল্পটির প্রাথমিক অর্থায়ন আইএফসি দেবে। পরবর্তী সময়ে, যদি অন্য কোথাও থেকে কম সুদে অর্থায়নের সুযোগ পাওয়া যায়, তবে সেটিও বিবেচনায় নেওয়া হবে।
প্রাণ–আরএফএল: কৃষিভিত্তিক শিল্প থেকে নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে
প্রাণ–আরএফএল গ্রুপের সূচনা হয়েছিল ১৯৮১ সালে, প্রয়াত শিল্পপতি আমজাদ খান চৌধুরীর হাত ধরে। সেনাবাহিনী থেকে অবসরের পর ফাউন্ড্রি ব্যবসার মাধ্যমে যাত্রা শুরু হয় এই শিল্পগোষ্ঠীর। রংপুরে প্রতিষ্ঠিত ‘রংপুর ফাউন্ড্রি লিমিটেড (আরএফএল)’ থেকে আজকের ৩১টিরও বেশি শিল্পপ্রতিষ্ঠানে রূপ নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। খাদ্যপণ্য, ভোগ্যপণ্য থেকে শুরু করে প্লাস্টিক, কৃষিপণ্য উৎপাদন, ইলেকট্রনিকস—সব ক্ষেত্রেই সফলভাবে নিজেদের অবস্থান তৈরি করেছে প্রাণ–আরএফএল।
বর্তমানে প্রাণের পণ্য বিশ্বের ১৪৫টিরও বেশি দেশে রপ্তানি হচ্ছে। এবার পরিবেশবান্ধব শক্তি খাতে প্রবেশ তাদের ব্যবসার বহুমাত্রিক সম্প্রসারণের আরেকটি অধ্যায়।
বিশ্বব্যাংক ও আইএফসির ভূমিকা
ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স করপোরেশন (আইএফসি) দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশে বেসরকারি খাতে উন্নয়নমূলক প্রকল্পে অর্থায়ন করে আসছে। তারা নবায়নযোগ্য জ্বালানির প্রসারে গুরুত্বারোপ করছে। প্রাণ–আরএফএল গ্রুপের সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পে অর্থায়নের মাধ্যমে আইএফসি মূলত বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি) অর্জনে সহায়ক ভূমিকা রাখতে চায়।
আইএফসির একটি সূত্র জানিয়েছে, এমন প্রকল্পগুলো শুধু কার্বন নিঃসরণ কমায় না, একই সঙ্গে কর্মসংস্থান সৃষ্টি, বিদ্যুৎ খাতে প্রতিযোগিতা বাড়ানো এবং শিল্প খাতের পরিবেশবান্ধব ব্যবস্থাপনায় সহায়ক হয়ে ওঠে।
পরিবেশ, অর্থনীতি ও শিল্প খাতে সম্ভাবন
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই ধরনের বিনিয়োগ বাংলাদেশের শিল্প খাতকে আরও টেকসই ও বৈশ্বিকভাবে প্রতিযোগিতার উপযোগী করে তুলবে। বিশেষত পোশাক রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে নবায়নযোগ্য জ্বালানির সহজলভ্যতা আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের কাছে একটি বড় আস্থার জায়গা তৈরি করবে।
বাংলাদেশে বর্তমানে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে সংযুক্ত হলেও, বেসরকারি পর্যায়ে সরাসরি বিক্রয় ও বিতরণের কার্যক্রম প্রায় নেই বললেই চলে। প্রাণ–আরএফএল গ্রুপের এ উদ্যোগ সফল হলে ভবিষ্যতে আরও অনেক প্রতিষ্ঠান এই খাতে আসতে আগ্রহী হবে।
উপসংহার
প্রাণ–আরএফএল গ্রুপের সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প শুধু একটি নতুন ব্যবসায়িক দিক নয়, বরং এটি বাংলাদেশের শিল্পখাতে পরিবেশবান্ধব ও টেকসই উৎপাদনের পথে এগিয়ে যাওয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এই উদ্যোগ সফল হলে দেশের নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে এবং বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের অবস্থান আরও সুদৃঢ় হবে।