ঈদের মাসে রেকর্ড ৩২৯ কোটি ডলার পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা

বাংলাদেশে রমজান ও ঈদুল ফিতরের আগমনে প্রবাসীদের পক্ষ থেকে রেকর্ড পরিমাণ রেমিট্যান্স এসেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের মার্চ মাসে প্রবাসীরা বৈধ ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে দেশে পাঠিয়েছেন ৩২৯ কোটি মার্কিন ডলার, যা দেশের ইতিহাসে এক মাসে সর্বোচ্চ রেমিট্যান্সের রেকর্ড।
এই রেকর্ড সংখ্যক রেমিট্যান্স আগমন দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। বিশেষ করে ডলার সংকট কিছুটা কাটিয়ে উঠেছে ব্যাংকিং খাত, স্থিতিশীল হয়েছে ডলারের বিনিময় হার এবং আমদানিকারকরা কিছুটা স্বস্তি পেয়েছেন আমদানি ব্যয়ের ক্ষেত্রে।
অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে নতুন মাইলফলক
২০২৪ সালের মার্চ মাসে দেশে রেমিট্যান্স এসেছিল ১৯৯ কোটি ডলার। এক বছরের ব্যবধানে ৬৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ঘটেছে। ফেব্রুয়ারি মাসে যেখানে প্রবাসী আয় ছিল ২৫২ কোটি ডলার, মার্চে তা এক লাফে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩২৯ কোটি ডলারে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মূলত রমজান ও ঈদুল ফিতরকে ঘিরে প্রবাসীদের ব্যয় বেড়ে যায়। পরিবারের কাছে টাকা পাঠানোর প্রবণতা বাড়ে। এবার সেই চাহিদা ইতিহাস গড়ে দিয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা গেছে, মার্চ মাসের প্রথম ২৪ দিনেই এসেছে ২৭০ কোটি ডলার, যা শেষ পর্যন্ত গিয়ে ঠেকেছে ৩২৯ কোটিতে। গত ডিসেম্বরেও সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স এসেছিল ২৬৩ কোটি ডলার, কিন্তু মার্চ মাসে সেই রেকর্ড ভেঙে নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে।
বৈধ পথে রেমিট্যান্সের ঝোঁক বাড়ছে
ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, অর্থ পাচার কমে আসা এবং সরকারের দিক থেকে প্রচলিত হুন্ডি ব্যবস্থার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের কারণে প্রবাসীরা এখন বৈধ ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠাতে উৎসাহিত হচ্ছেন। এর ফলে দেশে আসা বৈধ রেমিট্যান্সের পরিমাণ ক্রমাগত বাড়ছে।
সাবেক ব্যাংকার ও অর্থনীতিবিদরা বলছেন, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং অর্থনৈতিক নীতিতে সাম্প্রতিক কিছু ইতিবাচক পরিবর্তনের ফলে প্রবাসীদের আস্থাও ফিরে এসেছে। এতে বৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠানো অনেকটাই সহজ ও নির্ভরযোগ্য হয়েছে।
প্রবাসী আয়ের গুরুত্ব
প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম প্রধান উৎস। এটি দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে, কারণ এর বিপরীতে কোনো দায় তৈরি হয় না। বিপরীতে, রপ্তানি আয়ের বিপরীতে কাঁচামাল ও প্রযুক্তি আমদানির জন্য বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করতে হয়।
বিশ্লেষকরা বলছেন, রেমিট্যান্স বাড়লে দেশের বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্য রক্ষা সহজ হয়, ডলার রিজার্ভ বাড়ে, এবং মুদ্রানীতিতে স্থিতিশীলতা আসে। বর্তমানে যেখানে বৈদেশিক ঋণের পরিশোধ ও আমদানির খরচে বড় অঙ্কের ডলার প্রয়োজন, সেখানে প্রবাসী আয়ের ওপর নির্ভরতা আরও বেড়েছে।
রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ধারাবাহিক রেমিট্যান্স
২০২৪ সালের আগস্টে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর থেকে প্রবাসীরা প্রতি মাসে ২০০ কোটির বেশি ডলার পাঠিয়ে যাচ্ছেন। গত ফেব্রুয়ারিতে পাঠানো রেমিট্যান্স ছিল ২৫২ কোটি ৮০ লাখ ডলার, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ১৭ শতাংশ বেশি। জানুয়ারিতেও প্রবৃদ্ধি ছিল ৩ শতাংশ।
২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই-মার্চ) মোট রেমিট্যান্স এসেছে ২ হাজার ১৭৭ কোটি ডলার, যা আগের বছরের (২০২৩-২৪) একই সময়ের চেয়ে প্রায় ২৮ শতাংশ বেশি। আগের বছর এই সময় রেমিট্যান্স এসেছিল ১ হাজার ৭০৭ কোটি ডলার।
ডলারের দামে স্থিতিশীলতা
রেমিট্যান্স বৃদ্ধির ফলে দেশের ব্যাংকিং খাতে ডলারের সংকট অনেকটাই কমে এসেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্ধারিত সর্বোচ্চ ১২৩ টাকার মধ্যেই এখন ডলার কেনাবেচা হচ্ছে। একসময় এই দাম ১২৮ টাকা পর্যন্ত উঠেছিল, যা আমদানি ও বাজার ব্যবস্থাপনায় চাপ সৃষ্টি করেছিল।
বর্তমানে ডলারের দাম স্থিতিশীল থাকায় আমদানি ব্যয় কমছে, ফলে আমদানিকৃত খাদ্যপণ্যের দামেও উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে না। এতে দেশের মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে থাকছে এবং সাধারণ মানুষ কিছুটা স্বস্তি পাচ্ছে।
ব্যাংকগুলোর ভূমিকা ও প্রতিযোগিতা
আগে ব্যাংকগুলোর মধ্যে রেমিট্যান্স সংগ্রহে বেশ প্রতিযোগিতা থাকলেও বর্তমানে সেটি কিছুটা কমে এসেছে। ব্যাংকগুলো এখন অধিকাংশ সময় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্ধারিত সীমার মধ্যেই ডলার কিনছে। ফলে বাজারে অস্থিরতা কমেছে এবং রেমিট্যান্স গ্রহণ প্রক্রিয়াও অনেক সহজ হয়েছে।
ভবিষ্যতের সম্ভাবনা
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই ধারা অব্যাহত থাকলে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে রেমিট্যান্স ৩৫০০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে, যা দেশের অর্থনীতিতে নতুন মাইলফলক স্থাপন করবে। একই সঙ্গে এটি দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ পুনর্গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
তারা আরও বলেন, প্রবাসীদের জন্য সহজতর ও সাশ্রয়ী রেমিট্যান্স পাঠানোর পদ্ধতি চালু থাকলে বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স আরও বাড়বে। এক্ষেত্রে সরকার, ব্যাংক এবং প্রযুক্তি সংস্থাগুলোর যৌথ উদ্যোগ প্রয়োজন।