শত শত কোটি টাকা নিয়ে পালালো ফ্লাইট এক্সপার্ট!

বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় অনলাইন ট্রাভেল সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান ফ্লাইট এক্সপার্ট হঠাৎ করেই কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছে। শত শত কোটি টাকা নিয়ে প্রতিষ্ঠানটির মালিক বিদেশে পালিয়ে গেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এর ফলে গ্রাহক ও এজেন্সিগুলোর মধ্যে চরম ক্ষোভ ও অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।
ওয়েবসাইট ও অফিস বন্ধ, হঠাৎ উধাও মালিক
শনিবার সকাল থেকে ফ্লাইট এক্সপার্টের অফিস ও ওয়েবসাইট বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। তাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজে সর্বশেষ পোস্টটি ছিল হজ ২০২৬ সালের প্যাকেজ নিয়ে। এরপর থেকে প্রতিষ্ঠানটির কোনো সাড়া মেলেনি। সেলস ডিপার্টমেন্টের কর্মকর্তা মামুনুর রশিদ জানান, শুক্রবার রাতেই কোম্পানির মালিক দেশ ছেড়ে চলে গেছেন।
তিনি বলেন, “আমরা ভেবেছিলাম সাময়িক কোনো টেকনিক্যাল সমস্যা। কিন্তু আজ সকালে অফিসে এসে দেখি সব বন্ধ, মালিকের খোঁজ নেই।”
অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের তথ্য ফাঁস
ঘটনার পর ফ্লাইট এক্সপার্টের চিফ অপারেটিং অফিসার (সিওও) সালমান একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে বার্তা দিয়ে জানান, কোম্পানির শীর্ষ পর্যায়ের কিছু কর্মকর্তার বিশ্বাসঘাতকতা ও ভুল ব্যবস্থাপনার কারণে এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। তিনি অভিযোগ করেন, কিছু সহকর্মী পরিকল্পিতভাবে তার ওপর দোষ চাপিয়ে দেন এবং হঠাৎ করে কোম্পানির অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা তুলে নেন।
সালমানের দাবি, “আমি কোনোভাবেই কোম্পানি ছেড়ে যাওয়ার পক্ষে ছিলাম না। তবে চাপ ও হুমকির কারণে আমার পক্ষে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া অসম্ভব হয়ে পড়েছে।”
২০১৭ সালে যাত্রা শুরু, দ্রুত জনপ্রিয়তা
ফ্লাইট এক্সপার্ট ২০১৭ সালের মার্চ মাসে আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের সেবা চালু করে। অনলাইন টিকিট বুকিং, হোটেল রিজার্ভেশন, ট্যুর প্যাকেজ এবং ভিসা প্রসেসিং সেবার মাধ্যমে দ্রুতই গ্রাহকদের আস্থা অর্জন করে প্রতিষ্ঠানটি। বিশেষ করে সহজ পেমেন্ট ব্যবস্থা ও সাশ্রয়ী মূল্যের টিকিট অফারের কারণে স্বল্প সময়ে এটি দেশের অন্যতম বড় প্ল্যাটফর্মে পরিণত হয়।
এজেন্সি ও সাধারণ গ্রাহকদের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা অগ্রিম নিয়ে বিভিন্ন সেবা দিয়ে আসছিল ফ্লাইট এক্সপার্ট। ফলে এই আকস্মিক ঘটনার প্রভাব ব্যাপক।
ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকদের ক্ষোভ ও আতঙ্ক
ঘটনার পর থেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন বহু গ্রাহক। অনেকেই জানিয়েছেন, অগ্রিম অর্থ দিয়ে টিকিট কাটলেও এখনো ভ্রমণ করতে পারেননি। ফেসবুক গ্রুপগুলোতে অনেক গ্রাহক অন্যদেরকে দ্রুত নিজেদের টিকিটের স্ট্যাটাস যাচাই করার পরামর্শ দিচ্ছেন।
জয়িতা আফরিন নামে এক গ্রাহক লিখেছেন, “এত বড় প্রতিষ্ঠানের ওপর বিশ্বাস করে টাকা দিলাম, এখন দেখি তারা দেশেই নেই। আমরা কাকে বিশ্বাস করব?”
ভ্রমণ শিল্পে বড় ধাক্কা
বাংলাদেশের অনলাইন ট্রাভেল ইন্ডাস্ট্রি গত কয়েক বছরে দ্রুত বেড়েছে। এই শিল্পে আস্থার ওপর নির্ভর করেই ব্যবসা এগিয়ে যায়। তাই ফ্লাইট এক্সপার্টের এই ঘটনার ফলে পুরো খাতেই আস্থার সংকট তৈরি হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
ট্রাভেল এজেন্সি অ্যাসোসিয়েশনের একজন কর্মকর্তা জানান, “ফ্লাইট এক্সপার্টের মতো একটি প্রতিষ্ঠান যদি এভাবে অদৃশ্য হয়ে যায়, তাহলে ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠানগুলো বড় ধাক্কা খাবে। সাধারণ মানুষ আর সহজে অনলাইন সেবার ওপর আস্থা রাখতে পারবে না।”
আইনগত পদক্ষেপের প্রস্তুতি
এদিকে ক্ষতিগ্রস্ত এজেন্সি ও গ্রাহকরা ইতিমধ্যেই আইনগত পদক্ষেপ নেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। জানা গেছে, কয়েকটি ভ্রমণ সংস্থা মিলে সংশ্লিষ্ট থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করতে যাচ্ছেন। কর্তৃপক্ষও তদন্ত শুরু করতে পারে বলে সূত্রে জানা গেছে।
তবে এখন পর্যন্ত মালিক বা প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক কোনো বিবৃতি পাওয়া যায়নি। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা বিষয়টি খতিয়ে দেখছেন বলে জানা গেছে।
অনলাইন গ্রাহকদের জন্য সতর্কবার্তা
ঘটনার পর বিশেষজ্ঞরা অনলাইনে টিকিট বুক করার সময় আরও সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়েছেন। তারা বলছেন, পরিচিত কোম্পানি হলেও আগে থেকেই প্রতিষ্ঠানটির আর্থিক অবস্থা ও নির্ভরযোগ্যতা যাচাই করা উচিত।
ভবিষ্যতে যেন এমন ঘটনা আর না ঘটে, সে জন্য একটি শক্তিশালী নীতিমালা তৈরির আহ্বান জানিয়েছেন ভ্রমণ খাতের অভিজ্ঞরা।
সারসংক্ষেপ
ফ্লাইট এক্সপার্টের মালিকদের হঠাৎ উধাও হয়ে যাওয়া ও কোটি কোটি টাকার অজানা গন্তব্যে চলে যাওয়া দেশের অনলাইন ট্রাভেল ইন্ডাস্ট্রির জন্য একটি বড় ধাক্কা। গ্রাহকরা যেমন ক্ষতিগ্রস্ত, তেমনি এজেন্সিগুলোরও অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে। এখন সবার দৃষ্টি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সরকারের পরবর্তী পদক্ষেপের দিকে। প্রশ্ন উঠছে, এই ঘটনায় ভোক্তাদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে কতটা সময় লাগবে?
এম আর এম – ০৬৩৯, Signalbd.com