বানিজ্য

ব্যাংক দেউলিয়া হলে গ্রাহক সর্বোচ্চ ২ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ পাবেন

সম্প্রতি দেশের ব্যাংকিং খাতে বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে। সরকার পরিবর্তনের পর ১১টি দুর্বল ব্যাংকের পর্ষদ পুনর্গঠিত হয়েছে। এসব ব্যাংকের মধ্যে কয়েকটি ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম হলেও বেশ কয়েকটি ব্যাংক এখনো আমানতকারীদের টাকা ফেরত দিতে হিমশিম খাচ্ছে।

এই পরিস্থিতিতে সাধারণ আমানতকারীদের মধ্যে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে যদি কোনো ব্যাংক দেউলিয়া হয় বা বন্ধ হয়ে যায়, তখন একজন গ্রাহক কত টাকা ফেরত পাবেন—এই প্রশ্ন এখন ব্যাপক আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে।

নতুন ক্ষতিপূরণ নীতি

বর্তমানে বাংলাদেশে বিদ্যমান ‘আমানত সুরক্ষা আইন’ অনুযায়ী, কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান অবসায়িত হলে প্রতিটি আমানতকারী সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা পর্যন্ত ক্ষতিপূরণ পেতেন। তবে সাম্প্রতিক এক ঘোষণায় অন্তর্বর্তী সরকারের নিয়োগ করা বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর জানান, এ ক্ষতিপূরণের পরিমাণ দ্বিগুণ করা হয়েছে। এখন থেকে কোনো ব্যাংক দেউলিয়া হলে আমানতকারীরা সর্বোচ্চ দুই লাখ টাকা পর্যন্ত ফেরত পাবেন।

গত ৮ সেপ্টেম্বর এক সংবাদ সম্মেলনে ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, “আমরা আমানত বীমার পরিমাণ এক লাখ টাকা থেকে দুই লাখ টাকায় উন্নীত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এর ফলে দেশের প্রায় ৯৫ শতাংশ আমানতকারীর অর্থ নিরাপদ হয়ে যাবে।”

কেন এই পরিবর্তন?

বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে বেশ কিছু সমস্যার কারণে সরকার আমানত সুরক্ষার এই নতুন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কিছু দুর্বল ব্যাংক আমানতকারীদের টাকার সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ হচ্ছে, ফলে সাধারণ মানুষ তাদের সঞ্চিত অর্থ নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন। নতুন নীতির ফলে ক্ষুদ্র আমানতকারীদের সুরক্ষা আরও জোরদার হবে

৯৫ শতাংশ আমানতকারী এখন নিরাপদ

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমানে দেশে ১৫ কোটি ৭১ লাখ ২০ হাজার ২২৭টি আমানত অ্যাকাউন্ট রয়েছে। এর মধ্যে দুই লাখ বা তার নিচে অর্থ আছে ১৪ কোটি ৭১ লাখ ৩৩ হাজার ৭৩৩টি অ্যাকাউন্টে

অর্থাৎ, ৯৫ শতাংশের বেশি আমানতকারী এই নতুন নীতির আওতায় সম্পূর্ণ ক্ষতিপূরণ পাবেন। তবে যেসব গ্রাহকের অ্যাকাউন্টে দুই লাখ টাকার বেশি জমা আছে, তারা শুধু দুই লাখ টাকা পর্যন্তই ফেরত পাবেন।

আমানত বীমা তহবিলের বর্তমান অবস্থা

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছর শেষে ‘আমানত বীমা তহবিল’-এর মোট জমার পরিমাণ ছিল ১৪ হাজার ৪৭২ কোটি টাকা। বর্তমানে এই তহবিলের পরিমাণ ১৫ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে

গত পাঁচ বছরে এই তহবিলের আকার দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২১-২২ অর্থবছরের তুলনায় তহবিলের পরিমাণ ১,৭৯০ কোটি টাকা বা ১৪.১১ শতাংশ বেড়েছে

এই তহবিল গঠনের জন্য সব ব্যাংক থেকে নির্দিষ্ট হারে চাঁদা নেওয়া হয়। ফলে প্রতিটি ব্যাংক তাদের আমানতকারীদের জন্য বীমা সুবিধা দিয়ে থাকে।

কোনো ব্যাংক দেউলিয়া হলে কী করবেন?

যদি কোনো ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে যায়, তবে গ্রাহকদের নিম্নলিখিত ধাপগুলো অনুসরণ করতে হবে:

  1. বাংলাদেশ ব্যাংকের ঘোষণা: দেউলিয়া ঘোষিত ব্যাংকের তালিকা এবং ক্ষতিপূরণের বিস্তারিত তথ্য বাংলাদেশ ব্যাংক প্রকাশ করবে।
  2. ক্ষতিপূরণ আবেদন: ব্যাংক বন্ধ হলে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে আমানতকারীদের ক্ষতিপূরণের জন্য আবেদন করতে হবে।
  3. পরিশোধ প্রক্রিয়া: ব্যাংক অবসায়িত হওয়ার পর ৬ মাসের মধ্যে ক্ষতিপূরণ প্রদান করা হবে
  4. দুই লাখ টাকার বেশি আমানতকারীদের অবস্থা: যাদের জমা অর্থ দুই লাখ টাকার বেশি, তারা কেবলমাত্র দুই লাখ টাকা পর্যন্ত ফেরত পাবেন। বাকি অর্থ আদায়ের জন্য ব্যাংকের সম্পদ বিক্রি হলে পরে আরও অর্থ ফেরত পাওয়ার সুযোগ থাকতে পারে।

আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আমানত সুরক্ষা বীমা চালু রয়েছে। তবে বাংলাদেশে বর্তমানে সর্বোচ্চ দুই লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়া হলেও যুক্তরাষ্ট্রে এ সীমা ২,৫০,০০০ ডলার এবং যুক্তরাজ্যে ৮৫,০০০ পাউন্ড

বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, সরকারের উচিত আন্তর্জাতিক মান অনুসারে প্রিমিয়াম নির্ধারণ করা এবং ব্যাংকগুলোর ওপর আরও কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর জানিয়েছেন, দেশের ব্যাংকিং খাতের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে আরও সংস্কার আনা হবে। ভবিষ্যতে ব্যাংক দেউলিয়া হওয়ার ঝুঁকি কমাতে:

  • দুর্বল ব্যাংকগুলোর একীভূতকরণ বা বন্ধ করে দেওয়ার নীতি গ্রহণ করা হবে।
  • নিয়ন্ত্রণ ও তদারকি বাড়ানো হবে যাতে ব্যাংকগুলো ঝুঁকিপূর্ণ ঋণ না দেয়।
  • আমানতকারীদের আস্থা ফেরাতে বিস্তৃত সংস্কার কার্যক্রম হাতে নেওয়া হচ্ছে।

শেষ কথা

ব্যাংকিং খাতের সাম্প্রতিক পরিবর্তনের ফলে ক্ষুদ্র আমানতকারীদের জন্য একটি ইতিবাচক বার্তা এসেছে। নতুন ক্ষতিপূরণ নীতির ফলে প্রায় ৯৫ শতাংশ আমানতকারীর অর্থ নিরাপদ থাকবে। তবে বড় আমানতকারীদের জন্য এটি কিছুটা চিন্তার বিষয় হতে পারে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এমন নীতি গৃহীত হলে দীর্ঘমেয়াদে দেশের ব্যাংকিং খাত আরও শক্তিশালী হবে এবং জনগণের আস্থা বৃদ্ধি পাবে। তবে এটি নিশ্চিত করতে হবে যে, ব্যাংকগুলো যথাযথভাবে পরিচালিত হচ্ছে এবং দেউলিয়া হওয়ার ঝুঁকি কমানো হচ্ছে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button