অর্থনীতি

বাংলাদেশের চা রপ্তানি বাড়াতে বড় পরিকল্পনায় সরকার

বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী চা শিল্পকে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিষ্ঠা করতে নতুন উদ্যোগ নিচ্ছে সরকার। দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে বৈদেশিক বাজারে চা রপ্তানি বাড়ানো এখন সরকারের অন্যতম অগ্রাধিকার। ২১ মে ২০২৫, বুধবার জাতীয় চা দিবস উপলক্ষে আয়োজিত এক বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানে এই ঘোষণা দেন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন।

তিনি বলেন, “বাংলাদেশে চা শুধু একটি পানীয় নয়, এটি একটি সম্ভাবনাময় রপ্তানি পণ্য এবং জাতীয় সম্পদ। আমরা চাই চা শিল্পে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনে আন্তর্জাতিক বাজারে এর গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে। এর মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিও সমৃদ্ধ হবে।”

জাতীয় চা দিবস: পুরস্কার, প্রত্যাশা ও প্রতিশ্রুতি

জাতীয় চা দিবস উপলক্ষে রাজধানীর ঐতিহাসিক ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে এক জমকালো অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানে আটটি ক্যাটাগরিতে দেশের চা-শিল্পে বিশেষ অবদান রাখায় ‘জাতীয় চা পুরস্কার ২০২৫’ প্রদান করা হয়। এর মধ্যে সর্বোচ্চ উৎপাদনকারী কারখানা হিসেবে দুটি প্রতিষ্ঠান বিশেষ পুরস্কারে ভূষিত হয়।

প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে বিজয়ীদের হাতে সনদ ও ক্রেস্ট তুলে দেন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন। অনুষ্ঠানের শুরুতে বেলুন উড়িয়ে চা দিবসের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন তিনি এবং পরে চা মেলার বিভিন্ন স্টল ঘুরে দেখেন।

চা শিল্পের বাধা ও সম্ভাবনার কথা বললেন বাণিজ্য উপদেষ্টা

বাণিজ্য উপদেষ্টা তাঁর বক্তব্যে বলেন, “চা শিল্পে এখনো নানা ধরনের শুল্ক, কর এবং প্রশাসনিক জটিলতা রয়েছে। আমরা এই সমস্যাগুলো নিরসন করতে চাই। সুশাসন ও ন্যায্যতার মাধ্যমে চা শিল্পে স্থিতিশীলতা আনাই আমাদের লক্ষ্য।”

তিনি আরও বলেন, “দেশে প্রতিবছর ৮ থেকে ১০ হাজার কোটি টাকার চা বিক্রি হয়, কিন্তু সেই অর্থের সুষম বণ্টন হয় না। বিশেষ করে চা শ্রমিকরা ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত হন। এই চক্র ভেঙে দিতে হবে। চা শিল্পকে জাতীয় সম্পদ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে হবে।”

চা শ্রমিকদের সম্মান ও অধিকার নিশ্চিত করার ডাক

অনুষ্ঠানে চা শ্রমিকদের প্রতিনিধিরাও উপস্থিত ছিলেন এবং তারা তাদের অভিজ্ঞতা ও সমস্যার কথা তুলে ধরেন। জাতীয় চা পুরস্কার ২০২৪-এর বিজয়ী শ্রমিক জেসমিন আক্তার তাঁর বক্তব্যে বলেন, “আমরা কঠোর পরিশ্রম করি। কিন্তু জীবনের মান উন্নত হয় না। আমরা চাই আমাদের প্রাপ্য অধিকার এবং সম্মান।”

চা শ্রমিক ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি নৃপেন পাল বলেন, “চা শিল্পে শ্রমিকদের কণ্ঠস্বর তুলে ধরতে হবে। বাগানে কাজ করা এই মানুষগুলোই তো দেশের জন্য বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের ভিত্তি গড়ে দিচ্ছেন।”

উৎপাদন ও রপ্তানির বর্তমান চিত্র

বাংলাদেশ চা বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে দেশে চা উৎপাদন হয়েছিল প্রায় ১০ কোটি কেজি। এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে ব্যবহৃত হয়েছে প্রায় ৯ কোটি কেজি, এবং মাত্র ১ কোটি কেজি রপ্তানি হয়েছে। অথচ বিশ্লেষকরা বলছেন, সঠিক পরিকল্পনা ও সরকারি সহায়তা পেলে বছরে ৩ থেকে ৫ কোটি কেজি চা রপ্তানি সম্ভব।

বর্তমানে বাংলাদেশের চা রপ্তানি হয় প্রধানত পাকিস্তান, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, যুক্তরাজ্য, এবং রাশিয়ায়। তবে বিগত কয়েক বছরে চীনা বাজারেও প্রবেশ করেছে বাংলাদেশের চা। এক্সপোর্ট প্রমোশন ব্যুরো (EPB) এবং বাংলাদেশ চা বোর্ড এরইমধ্যে যৌথভাবে কিছু ট্রেড মিশন পরিচালনা করছে।

চা শিল্পে কর কাঠামো ও নীতিগত সংস্কারের দাবি

অনুষ্ঠানে উপস্থিত টি ট্রেডার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি শাহ মইনুদ্দিন হাসান বলেন, “চা শিল্পে বিদ্যমান কর কাঠামো ব্যবসায়িক সম্প্রসারণের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। উৎপাদক, রপ্তানিকারক ও পরিবেশকদের জন্য ন্যায্য পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।”

বাংলাদেশীয় চা সংসদের সভাপতি কামরান টি রহমান বলেন, “আমরা চাই সরকারের কাছ থেকে নির্দিষ্ট রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা, চা রপ্তানিতে নগদ প্রণোদনা ও সহজ ঋণ সুবিধা। সেইসঙ্গে চা গবেষণার জন্য বাজেট বাড়ানো দরকার।”

চা দিবসে জনসচেতনতা ও বিপণন জোরদার করার তাগিদ

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, চা রপ্তানি বাড়াতে শুধু উৎপাদন নয়, উন্নত প্যাকেজিং, বিপণন কৌশল এবং আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডিং প্রয়োজন। অনেক দেশেই ‘অর্গানিক টি’ বা ‘হেরিটেজ টি’ নামে বাজার তৈরি করে চা রপ্তানি করে থাকে। বাংলাদেশের চা শিল্পেও এরকম উদ্যোগ দরকার।

জাতীয় চা দিবসে একাধিক প্যানেল আলোচনায় উঠে এসেছে এই বিষয়গুলো। বক্তারা বলেন, তরুণ উদ্যোক্তাদের চা শিল্পে নিয়ে আসার জন্য ইনকিউবেশন প্রোগ্রাম চালু করা যেতে পারে। পাশাপাশি, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলায় বাংলাদেশের নিজস্ব চায়ের স্টল বৃদ্ধি করা জরুরি।

চা—শুধু পানীয় নয়, অর্থনীতির চালিকাশক্তি

বিশ্লেষকরা বলছেন, চা শুধু একটি ঐতিহ্যবাহী কৃষিপণ্য নয়—এটি বাংলাদেশের কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ খাত। বর্তমানে প্রায় ১ লাখ ৫০ হাজার শ্রমিক সরাসরি চা বাগানে কর্মরত। পরোক্ষভাবে যুক্ত আরও কয়েক লাখ মানুষ।

চা শিল্পে আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার, পরিবেশবান্ধব পদ্ধতিতে উৎপাদন এবং জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার মতো উদ্যোগ নেওয়া না হলে, এই খাত টিকবে না।

ঐতিহ্যের চা শিল্পকে বিশ্বদরবারে পৌঁছাতে প্রস্তুত বাংলাদেশ

বাংলাদেশ সরকার এখন চা শিল্পকে জাতীয় সম্পদে রূপান্তর করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। শুধু অভ্যন্তরীণ বাজারে নয়, আন্তর্জাতিক বাজারেও বাংলাদেশের চা যেন সুপরিচিত হয়, সে জন্য সরকার, উদ্যোক্তা, রপ্তানিকারক এবং শ্রমিক—সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন।

জাতীয় চা দিবস ২০২৫-এ ঘোষিত পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়ন হলে অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশ হয়ে উঠতে পারে বিশ্বের অন্যতম চা রপ্তানিকারক দেশ।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button