বানিজ্য

বন্ধ চিনিকল আধুনিকায়নে অর্থায়নে আগ্রহী জাপানি প্রতিষ্ঠান

সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্ব ও উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে দেশের বন্ধ ছয় চিনিকলকে আধুনিক ও লাভজনক করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। ২০২০ সালের ডিসেম্বরে পরিচালন অদক্ষতার কথা বলে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার এগুলো বন্ধ করে দেয়। শিল্প মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে—বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশন (বিএসএফআইসি) এসব কারখানা আধুনিকায়ন করতে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে আলোচনা করছে। এটি জাপান ব্যাংক ফর ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন (জেবিআইসি) ও এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট ব্যাংক অব থাইল্যান্ডের (এক্সিম) যৌথ উদ্যোগ ও সম্ভাব্য অর্থায়নের প্রস্তাব সামনে নিয়ে আসে। বেশিরভাগ অর্থ দেবে জেবিআইসি। গত ১৬ মার্চ শিল্প মন্ত্রণালয় এ উদ্যোগের বিষয়ে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) মতামত জানতে চায়। কারণ এতে বেসরকারি ও বিদেশি বিনিয়োগ থাকবে। গত বছরের জুলাইয়ে রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিকলগুলোর আধুনিকায়নে বিএসএফআইসি ও বিতর্কিত এস আলম গ্রুপের মধ্যে সমঝোতা স্মারক সই হওয়ার কথা জানানো হয়। কিন্তু গত বছরের আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ও এস আলম গ্রুপের আর্থিক কেলেঙ্কারি প্রকাশিত হলে অন্তর্বর্তী সরকার ওই চুক্তি থেকে সরে আসে। গত মাসে আরব আমিরাতভিত্তিক শারকারা ইন্টারন্যাশনাল (এফজেডসি), থাইল্যান্ডের সুটেক ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেড ও জাপানের মারুবেনি প্রোটেকস করপোরেশন চিনি কলগুলো ঢেলে সাজাতে যৌথ উদ্যোগে আগ্রহ দেখিয়ে শিল্প মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব জমা দেয়। বাংলাদেশে বিদ্যুৎ-সাশ্রয়ী, প্রযুক্তিনির্ভর ও পরিবেশবান্ধব ইক্ষু ও রপ্তানিমুখী মদ তৈরিতে বিএসএফআইসি ২০১৯ সালের অক্টোবরে এই তিন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক সই করে। কিন্তু এরপর থেকে প্রস্তাবটি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে আটকে আছে। শিল্প মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডেইলি স্টারকে বলেছেন, সর্বশেষ প্রস্তাবটি বন্ধ হয়ে যাওয়া চিনিকলগুলোকে আধুনিক ও লাভজনক করতে উপযুক্ত বলে মনে হচ্ছে। ‘এ ধরনের বিনিয়োগে তাদের মতামত বাধ্যতামূলক হওয়ায় আমরা ইতোমধ্যে বিডাকে চিঠি দিয়েছি। এই খাতকে আবারও লাভজনক করা সম্ভব। তবে এর জন্য প্রযুক্তি ও ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত উন্নতির প্রয়োজন।’ বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরী ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘ব্যবসা করা সরকারের কাজ নয়। প্রতিযোগিতা ও দক্ষতা বাড়াতে লোকসানে থাকা কারখানাগুলোকে বেসরকারি খাতে দেওয়া উচিত।’ তিনি মনে করেন, সরকারি চিনিকলগুলোকে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া হলে অদক্ষতার কারণে যে লোকসান হয় তা বন্ধ হবে। এ ধরনের কারখানা দক্ষতার সঙ্গে পরিচালনার জন্য বেসরকারি খাত অনেক বেশি সক্ষম। শিল্প মন্ত্রণালয় থেকে বিডাকে দেওয়া চিঠিতে বলা হয়েছে, প্রস্তাবিত প্রকল্পে বন্ধ ছয় চিনিকল সম্পূর্ণ সরকারি মালিকানা বা বিএসএফআইসি ও বেসরকারি বিনিয়োগকারীদের যৌথ উদ্যোগে পুনরুজ্জীবিত করা হবে। জেবিআইসি ও এক্সিম ব্যাংক বিদেশ থেকে যন্ত্রপাতি ও নকশা কিনতে ঋণ দেবে। বাংলাদেশ সরকার স্থানীয় নির্মাণ ও অবকাঠামো খাতে অর্থায়ন করবে। প্রস্তাবের আওতায় শারকারা, সুটেক ও মারুবেনি চিনিকলগুলোর প্রযুক্তিগত দক্ষতা, আধুনিক যন্ত্রপাতি ও ব্যবস্থাপনায় কাজ করবে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিনিয়োগকারীদের এক প্রতিনিধি ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘চিনিকলগুলো পুনরুজ্জীবিত করা হলে আখ চাষিরা লাভবান হবেন।’ ‘চিনিকলগুলো পুনরুজ্জীবন করা হলে শুধু কর্মসংস্থানই সৃষ্টি করবে না, আখ চাষের ওপর নির্ভর করা হাজার হাজার কৃষক উপকৃত হবেন।’ শিল্প মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, সরকার বর্তমানে অংশীদারিত্ব ও অর্থায়ন চুক্তির কাঠামো চূড়ান্ত করতে আন্তর্জাতিক কনসোর্টিয়ামের প্রস্তাব পর্যালোচনা করছে। বিডা প্রকল্পের বিনিয়োগের সম্ভাবনা ও নিয়ন্ত্রক দিকগুলো মূল্যায়ন করছে। বিএসএফআইসির সচিব মোহাম্মদ মুজিবুর রহমান ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘এই উদ্যোগের সর্বশেষ তথ্য তার জানা নেই। চিনি শিল্পকে টেকসই ও প্রতিযোগিতামূলক করা হলে সবাই উপকৃত হবেন। সফলভাবে বাস্তবায়িত হলে এ প্রকল্প দেশের চিনিকলগুলোকে আরও দক্ষ, প্রতিযোগিতামূলক ও লাভজনক করে নতুন যুগের সূচনা করতে পারে। দেশের চিনি শিল্প দীর্ঘদিন ধরে মেয়াদোত্তীর্ণ যন্ত্রপাতি, স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত চিনির চাহিদা কম ও আর্থিক ক্ষতির মতো সংকটে আছে। ফলে ১৫ চিনিকলের তত্ত্বাবধানে থাকা বিএসএফআইসি ঋণে জর্জরিত। প্রকল্পটি কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও আমদানি করা চিনির ওপর নির্ভরতা কমানোসহ বেশ কয়েকটি অর্থনৈতিক সুবিধা পাওয়া যাবে বলে আশা করা হচ্ছে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আধুনিকায়নের উদ্যোগ না নিলে বাকি নয় চিনিকলও লোকসানে পড়বে।

এই প্রকল্পের মাধ্যমে, বন্ধ চিনিকলগুলি পুনরায় চালু করা হলে, দেশের চিনি শিল্পে একটি নতুন প্রাণ সঞ্চারিত হবে। এটি শুধুমাত্র অর্থনৈতিক দিক থেকে লাভজনক হবে না, বরং কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং কৃষকদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

প্রকল্পের সম্ভাব্য সুবিধা:

  • কর্মসংস্থান সৃষ্টি: চিনিকলগুলি পুনরায় চালু হলে, স্থানীয় জনগণের জন্য নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে।
  • কৃষকদের আয় বৃদ্ধি: আখ চাষের উপর নির্ভরশীল হাজার হাজার কৃষক তাদের উৎপাদিত ফসলের ন্যায্য মূল্য পাবেন।
  • আমদানি নির্ভরতা হ্রাস: দেশীয় চিনির উৎপাদন বৃদ্ধি পেলে, বিদেশ থেকে চিনি আমদানির পরিমাণ কমে আসবে।
  • অর্থনৈতিক উন্নয়ন: এই প্রকল্প দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে এবং জাতীয় আয় বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে।

প্রকল্পের চ্যালেঞ্জসমূহ:

  • আর্থিক বিনিয়োগ: চিনিকলগুলির আধুনিকীকরণের জন্য প্রচুর অর্থের প্রয়োজন, যা একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
  • প্রযুক্তিগত উন্নয়ন: আধুনিক প্রযুক্তি এবং যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে চিনিকলগুলির উৎপাদন ক্ষমতা বাড়াতে হবে।
  • ব্যবস্থাপনা দক্ষতা: চিনিকলগুলির সুষ্ঠু পরিচালনার জন্য দক্ষ ব্যবস্থাপনার প্রয়োজন।
  • সরকারি ও বেসরকারি সমন্বয়: সরকারি ও বেসরকারি বিনিয়োগকারীদের মধ্যে সমন্বয় সাধন করা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

এই প্রকল্প সফলভাবে বাস্তবায়িত হলে, দেশের চিনি শিল্পে একটি নতুন যুগের সূচনা হবে এবং এটি জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button