মূল্যস্ফীতি: কোন কোন বিষয়গুলো দায়ী?

বিগত সরকারের অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনার কারণে বিগত কয়েক বছর ধরে দেশের মানুষ চরম মূল্যস্ফীতির সম্মুখীন হয়েছে। এর মধ্যে খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি ছিল সবচেয়ে বেশি। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি, ডলারের বিনিময় হারের ঊর্ধ্বগতি, রিজার্ভ হ্রাস, অর্থ পাচার এবং বাজারে পণ্যের অপ্রতুল সরবরাহ-সহ বিভিন্ন কারণে এই মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি পেয়েছে।
মূল্যস্ফীতির প্রধান কারণসমূহ:
- জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি: জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির ফলে পণ্য উৎপাদন, পরিবহন ও বিতরণের খরচ বেড়ে যায়, যা দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতে সরাসরি প্রভাব ফেলে।
- রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ: এই যুদ্ধের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে, যা বাংলাদেশের মতো আমদানিনির্ভর দেশের মূল্যস্ফীতিকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
- ডলারের মূল্যবৃদ্ধি ও টাকার অবমূল্যায়ন: ডলারের মূল্যবৃদ্ধির ফলে আমদানি খরচ বেড়েছে, যার প্রভাব পণ্যের দামে পড়েছে। বিগত সরকার আমদানি শুল্ক সমন্বয় না করায় এই সমস্যা আরও প্রকট হয়েছে।
- রিজার্ভ হ্রাস ও অর্থ পাচার: রিজার্ভ কমে যাওয়ায় এবং বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচারের কারণে ডলারের চাহিদা বেড়েছে, যা টাকার মূল্য কমিয়ে দিয়েছে।
- বাজারে পণ্যের অপ্রতুল সরবরাহ: চাহিদার তুলনায় বাজারে পণ্যের সরবরাহ কম থাকায় মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি পেয়েছে।
- অতিরিক্ত মুদ্রা ছাপানো: বিগত সরকার দুর্বল ব্যাংকগুলোকে রক্ষার জন্য এবং বাজেট ঘাটতি পূরণের জন্য অতিরিক্ত টাকা ছাপিয়েছে। এর ফলে বাজারে অর্থের সরবরাহ বেড়েছে এবং মূল্যস্ফীতি আরও বেড়েছে।
- ব্যাংক খাতে দুর্নীতি ও লুটপাট: ব্যাংক খাতে ব্যাপক দুর্নীতি ও লুটপাটের কারণে আর্থিক খাতে অস্থিতিশীলতা তৈরি হয়েছে, যা মূল্যস্ফীতিকে প্রভাবিত করেছে।
পরিসংখ্যান ও বিশ্লেষণ:
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২০ সালের জুন মাসে দেশে প্রচলিত মুদ্রার পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৮ হাজার ৯৪ কোটি টাকা, যা ২০২৩ সালের জুন মাসে বেড়ে দাঁড়ায় ৩ লাখ ১১ হাজার ৯৪৮ কোটি টাকায়। অর্থাৎ, মাত্র তিন বছরে প্রচলিত মুদ্রার পরিমাণ ৪৯ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২২ সালের আগস্টে মূল্যস্ফীতি সর্বোচ্চ ৯.৫২ শতাংশে পৌঁছায় এবং ২০১৪ সালের জুলাই মাসে তা ১১.৬৬ শতাংশে দাঁড়ায়, যা ২০১১ সালের পর সর্বোচ্চ।
বাংলাদেশ ব্যাংক ২০২২-২৩ অর্থবছরে রেপো রেট এবং রিভার্স রেপো রেট বৃদ্ধি করে মূল্যস্ফীতি কমানোর চেষ্টা করে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরেও এই ধারা অব্যাহত থাকে এবং রেপো রেট ৮.৫০ শতাংশে আনা হয়। তবে, এই পদক্ষেপগুলো মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে যথেষ্ট ছিল না।
২০২২-২৩ অর্থবছরে সরকার বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ৯৮ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেয়, যার মধ্যে ৮০ হাজার কোটি টাকা ছাপিয়ে সরকারের সিকিউরিটিজ কেনা হয়। ২০২৩-২৪ অর্থবছরেও দুর্বল ব্যাংকগুলোকে উদ্ধারের জন্য টাকা ছাপানো হয় এবং ২০২৪ সালের শুরুতে বিদ্যুৎ ও সার বন্ডের বিপরীতে টাকা ছাপানো হয়। এর ফলে মূল্যস্ফীতি আরও ত্বরান্বিত হয়েছে।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের উপায়:
- বাজার পর্যবেক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণ: বাজার পর্যবেক্ষণের জন্য অর্থনীতিবিদদের নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে, যাতে তারা বাজার পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণ নির্ধারণ করতে পারেন।
- মজুতদারদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা: মজুতদার ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে, যাতে তারা বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করতে না পারে।
- প্রতিযোগিতা কমিশনের সক্রিয় ভূমিকা: বাজার নিয়ন্ত্রণে প্রতিযোগিতা কমিশনকে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে হবে।
- চাঁদাবাজি বন্ধ: মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে চাঁদাবাজি বন্ধ করতে হবে।
- বিনিয়োগ বৃদ্ধি: দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে উদ্যোগ নিতে হবে, যাতে পণ্যের সরবরাহ বাড়ে এবং মূল্যস্ফীতি কমে।
- সুদের হার কমানো: ব্যবসায়ীদের উৎসাহ দেওয়ার জন্য সুদের হার কমানো উচিত।
- সমন্বিত উদ্যোগ: মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকার, বাংলাদেশ ব্যাংক এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন।
বর্তমান পরিস্থিতি ও সম্ভাবনা:
বর্তমানে মূল্যস্ফীতি ছাড়া অন্যান্য অর্থনৈতিক সূচকগুলো উন্নতির দিকে যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক আশা করছে, জুনের মধ্যে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসবে। রিজার্ভ বৃদ্ধি, রপ্তানি বৃদ্ধি এবং রেমিট্যান্স প্রবাহের কারণে টাকার মান ধরে রাখা সম্ভব হবে।
উপসংহার:
মূল্যস্ফীতি একটি জটিল সমস্যা, যার সমাধানে সমন্বিত ও কার্যকর পদক্ষেপ প্রয়োজন। বিগত সরকারের অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা এবং কিছু নীতিগত ত্রুটির কারণে এই সমস্যা আরও প্রকট হয়েছে। বর্তমান সরকার সঠিক নীতি ও পদক্ষেপের মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হবে বলে আশা করা যায়।
লেখক: অর্থনীতিবিদ, চেয়ারম্যান
ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি)
অনুলিখন: দুয়া রায়হান