বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় ‘জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের কার্যালয়’ (OHCHR) মিশন স্থাপনের জন্য সমঝোতা স্মারকের খসড়া অনুমোদন করেছে জাতীয় উপদেষ্টা পরিষদ। এ সিদ্ধান্ত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার পরিচালিত উপদেষ্টা পরিষদের বৃহস্পতিবার (১০ জুলাই) তেজগাঁওয়ের কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত সভায় গৃহীত হয়। প্রধান উপদেষ্টা ও নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বৈঠকে জাতিসংঘের এই মিশন প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া গতিশীল করার জন্য একমত হয় সংশ্লিষ্ট সবাই।
জাতিসংঘ মানবাধিকার মিশন স্থাপনের গুরুত্ব
জাতিসংঘের ‘নির্যাতন এবং অন্যান্য নিষ্ঠুর, অমানবিক বা মর্যাদাহানিকর আচরণ বা শাস্তির বিরুদ্ধে কনভেনশন’(Convention Against Torture and Other Cruel, Inhuman or Degrading Treatment or Punishment) এবং এর ঐচ্ছিক প্রটোকল অনুসারে, একটি স্বাধীন মানবাধিকার পর্যবেক্ষণ মিশন স্থাপনের মাধ্যমে দেশের মানুষের মানবাধিকার সুরক্ষা ও উন্নয়নে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা আরও জোরদার হবে। ২০০২ সালে গৃহীত এই প্রটোকলের মূল লক্ষ্য হলো বিশ্বজুড়ে নির্যাতন ও অমানবিক আচরণের বিরুদ্ধে কার্যকর প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিশ্চিত করা।
বাংলাদেশ ১৯৯৮ সালে এই মূল কনভেনশনে যোগদান করলেও, সম্প্রতি ঐচ্ছিক প্রটোকলে যুক্ত হওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, যা মিশন স্থাপনের পথ প্রশস্ত করেছে।
উপদেষ্টা পরিষদের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত
জাতিসংঘের মানবাধিকার মিশন বিষয়ক খসড়া অনুমোদনের পাশাপাশি, উপদেষ্টা পরিষদ ‘জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ সংশোধন অধ্যাদেশ ২০২৫’ এর খসড়া নীতিগত ও চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে। মালয়েশিয়ার জোহর বাহরুতে বাংলাদেশের নতুন কনস্যুলেট জেনারেল স্থাপনের প্রস্তাবও এখানে অনুমোদিত হয়েছে, যা দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ বৃদ্ধি করবে।
দেশের বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা
উপদেষ্টা পরিষদে চলমান বন্যা পরিস্থিতি ও তৎসংক্রান্ত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিষয়েও আলোচনা হয়েছে। পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে মুসাপুর রেগুলেটর ও বামনি ক্লোজারের নকশা চূড়ান্তকরণ, ফেনীতে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ প্রকল্প ও নোয়াখালীর খাল ও ড্রেনেজ অবমুক্ত করার প্রয়োজনীয়তা উপস্থাপন করা হয়।
বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়নে এই দুই জেলার ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ মেরামত, তীর প্রতিরক্ষা ও পানি নিয়ন্ত্রণ অবকাঠামো মেরামতের কাজ বর্তমানে কার্যক্রমাধীন রয়েছে। উপদেষ্টা পরিষদকে এসব কাজের অগ্রগতি ও পরিকল্পনা সম্পর্কে অবহিত করা হয়।
মানবাধিকার উন্নয়নে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার নতুন দিগন্ত
জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের কার্যালয় ঢাকায় স্থাপনের মাধ্যমে বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আরও দৃঢ় নজরদারি পাবে। দেশের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের মানবাধিকার সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ, বিশ্লেষণ ও প্রতিবেদন তৈরি করা সহজতর হবে। পাশাপাশি, বিভিন্ন মানবাধিকার লঙ্ঘন প্রতিরোধে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণে সহায়ক হবে।
এটি বাংলাদেশ সরকারের মানবাধিকার রক্ষায় কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ এবং জাতিসংঘের সঙ্গে সমন্বয় বৃদ্ধির একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে ধরা হচ্ছে। বিশেষত, নির্যাতন ও অমানবিক আচরণের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে দেশের সুনাম রক্ষায় এ উদ্যোগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি: বর্তমান চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা
বাংলাদেশে মানবাধিকার রক্ষা এবং উন্নয়নে ইতোমধ্যেই সরকার বিভিন্ন আইন প্রণয়ন ও কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। কিন্তু মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা এখনও শঙ্কার কারণ। স্বাধীন তদন্তকারী সংস্থা ও আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণের অভাব অনেক সময় এই বিষয়গুলো নিয়ে প্রশ্ন তোলে।
এখন ঢাকায় জাতিসংঘের মানবাধিকার মিশন থাকায় দেশের বিভিন্ন স্থানে মানবাধিকার পরিস্থিতি আরও স্বচ্ছ ও সুসংহতভাবে মূল্যায়ন করা সম্ভব হবে। সরকারি, বেসরকারি ও আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে সমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমে মানবাধিকার উন্নয়ন কর্মসূচি আরও গতিশীল ও ফলপ্রসূ হবে।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতিক্রিয়া
বিশ্ব মানবাধিকার সংগঠনগুলো বাংলাদেশের এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছে। তারা বলছে, এটি দেশের মানুষের মৌলিক অধিকার রক্ষায় একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ, যা সরকারের মানবাধিকার সংক্রান্ত অঙ্গীকারকে শক্তিশালী করবে।
ঢাকায় জাতিসংঘ মানবাধিকার বিষয়ক মিশন স্থাপনের খসড়া অনুমোদন একদিকে দেশের মানবাধিকার সুরক্ষায় নতুন আশার সঞ্চার করেছে, অন্যদিকে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ও মানবিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। আশা করা যায়, এই পদক্ষেপ বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি আরও সুদৃঢ় করবে এবং বিশ্ব সম্প্রদায়ের কাছে দেশের ইতিবাচক চিত্র তুলে ধরবে।



