বানিজ্য

দুই কোম্পানির শেয়ারের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি, তদন্তের দাবি বিশেষজ্ঞদের

দেশের শেয়ারবাজারে দুই দুর্বল কোম্পানির শেয়ারের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। নিউলাইন ক্লথিংস ও ইয়াকিন পলিমারের শেয়ারের দাম গত দুই মাসে প্রায় দ্বিগুণ বেড়ে গেছে, যা বিনিয়োগকারীদের জন্য বড় ধরনের ঝুঁকি তৈরি করতে পারে বলে মনে করছেন বাজার বিশ্লেষকরা।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) কর্তৃপক্ষ শেয়ারের এই অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কারণ জানতে চেয়ে কোম্পানি দুটিকে চিঠি দিলেও এখনো কোনো জবাব পায়নি। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, কোনো একটি গোষ্ঠী কারসাজির মাধ্যমে শেয়ারের দাম বাড়াচ্ছে, যা বাজারে স্বাভাবিক লেনদেনের ধারাকে ব্যাহত করতে পারে।


নিউলাইন ক্লথিংস: নিয়মিত এজিএম নেই, তবুও শেয়ারের দাম বেড়েছে ৭৫%

দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪ সালে নিউলাইন ক্লথিংসের শেয়ারের বাজারমূল্য ছিল ৬ টাকা ৪০ পয়সা। আজ ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ তারিখে এই দাম বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১ টাকা ২০ পয়সায়। অর্থাৎ মাত্র দুই মাসে শেয়ারের দাম ৭৫ শতাংশ বেড়েছে, যা সাধারণ বাজার পরিস্থিতিতে অস্বাভাবিক বলে মনে করা হচ্ছে।

কিন্তু কোম্পানিটি বিনিয়োগকারীদের নিয়মিত লভ্যাংশ প্রদান করতে পারছে না এবং এর বার্ষিক সাধারণ সভা (এজিএম) নিয়মিতভাবে অনুষ্ঠিত হয় না। এ কারণেই নিউলাইন ক্লথিংস ‘জেড’ শ্রেণিভুক্ত কোম্পানি হিসেবে চিহ্নিত, যার শেয়ার কেনার জন্য কোনো ঋণসুবিধা পাওয়া যায় না।

শেয়ারবাজারে এই ধরনের দুর্বল কোম্পানির শেয়ারের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি সাধারণত কোনো স্বাভাবিক কারণ ছাড়াই ঘটে থাকে। এ বিষয়ে জানতে চেয়ে ডিএসই কর্তৃপক্ষ ১৩ ফেব্রুয়ারি কোম্পানিটিকে চিঠি দিলেও এখনো কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি।


ইয়াকিন পলিমার: দীর্ঘদিন লভ্যাংশ দেয়নি, তবুও মূল্যবৃদ্ধি ৭২%

একইভাবে ইয়াকিন পলিমারের শেয়ারের দাম গত দুই মাসে ৭২ শতাংশ বেড়েছে। ২২ ডিসেম্বর ২০২৪ সালে ডিএসইতে কোম্পানিটির শেয়ারের বাজারমূল্য ছিল ৮ টাকা ২০ পয়সা। আজ তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৪ টাকা ১০ পয়সায়।

কোম্পানিটির শেয়ারধারীদের দীর্ঘদিন ধরে কোনো লভ্যাংশ দেওয়া হয়নি। ২০২০ সালের পর থেকে এজিএম করতে পারছে না, কারণ কোম্পানির শেয়ার মালিকানা বদল হয়েছে এবং এ বিষয়ে আদালতের অনুমতির অপেক্ষায় রয়েছে। তবে এইসব সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও কোম্পানির শেয়ারমূল্য ধারাবাহিকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা স্বাভাবিক বাজার পরিস্থিতির সাথে মানানসই নয়।

ডিএসই কর্তৃপক্ষ ১২ ফেব্রুয়ারি কোম্পানিটিকে চিঠি দিয়ে শেয়ারবাজারে মূল্যবৃদ্ধির কারণ জানতে চেয়েছিল, কিন্তু আজ পর্যন্ত কোম্পানিটির পক্ষ থেকে কোনো জবাব পাওয়া যায়নি।


বাজার বিশ্লেষকদের উদ্বেগ ও সতর্কবার্তা

শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, বাজারে এই ধরনের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি প্রমাণ করে যে, কোনো একটি গোষ্ঠী কৃত্রিমভাবে শেয়ারের দাম বাড়িয়ে বাজারে কারসাজি করছে।

বাজার বিশ্লেষক রফিকুল ইসলাম বলেন,

“জেড ক্যাটাগরির কোম্পানি, যারা নিয়মিত লভ্যাংশ দেয় না এবং আর্থিক অবস্থাও দুর্বল, তাদের শেয়ারের দাম যদি কয়েক মাসে দ্বিগুণ হয়ে যায়, তাহলে এটি অবশ্যই একটি অস্বাভাবিক ঘটনা। এখানে বাজার কারসাজির আশঙ্কা রয়েছে।”

বাজার বিশ্লেষকরা আরও মনে করেন, বিনিয়োগকারীদের এই ধরনের শেয়ারে বিনিয়োগ করার ক্ষেত্রে অতিরিক্ত সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। অনেক সময় কারসাজির মাধ্যমে দাম বাড়িয়ে পরে বড় ধরনের দরপতনের মাধ্যমে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ক্ষতির মুখে ফেলা হয়।


ডিএসই ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার ভূমিকা

ডিএসই কর্তৃপক্ষ কোম্পানি দুটির কাছ থেকে চিঠির উত্তর না পাওয়ায় বিষয়টি এখন নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) নজরে আনতে পারে। বিএসইসি যদি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ না করে, তাহলে এই ধরনের বাজার কারসাজি ভবিষ্যতে আরও বাড়তে পারে।

এ বিষয়ে বিএসইসি’র সাবেক চেয়ারম্যান ফজলুর রহমান বলেন,

“নিয়ন্ত্রক সংস্থা এবং স্টক এক্সচেঞ্জের উচিত বাজার কারসাজির বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করা। বাজারে যদি কোনো অনিয়ম হয়ে থাকে, তাহলে তা কঠোরভাবে দমন করা প্রয়োজন।”


বিনিয়োগকারীদের জন্য সতর্কবার্তা

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, বিনিয়োগকারীদের উচিত শুধুমাত্র ভালো মৌলভিত্তির কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগ করা। কোনো কোম্পানি নিয়মিত লভ্যাংশ দিতে না পারলে বা এজিএম করতে না পারলে সেটির শেয়ার কেনার আগে ভালোভাবে বিশ্লেষণ করা জরুরি।

বাজার বিশ্লেষক আব্দুল করিম বলেন,

“নতুন বা অনভিজ্ঞ বিনিয়োগকারীরা অনেক সময় লোভের বশে উচ্চমূল্যে শেয়ার কিনে পরে ক্ষতির মুখে পড়েন। তাই বিনিয়োগের আগে ভালোভাবে কোম্পানির তথ্য যাচাই করা উচিত।”


উপসংহার

নিউলাইন ক্লথিংস ও ইয়াকিন পলিমারের শেয়ারের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি বাজারের স্বাভাবিক চাহিদা ও যোগানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এটি একটি সম্ভাব্য কারসাজির ইঙ্গিত দিতে পারে, যা নিয়ন্ত্রক সংস্থার তদন্তের আওতায় আনা প্রয়োজন।

নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও স্টক এক্সচেঞ্জ যদি যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ না করে, তাহলে ভবিষ্যতে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের জন্য আরও বড় ধরনের বিপদের আশঙ্কা রয়েছে। তাই বিনিয়োগের আগে সতর্ক থাকা এবং কোম্পানির প্রকৃত অবস্থা বিশ্লেষণ করাই হবে বিনিয়োগকারীদের জন্য বুদ্ধিমানের কাজ।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button