বানিজ্য

বাড়তি ডলার ব্যবহারে নতুন নীতি, ব্যাংক পাবে স্বাধীনতা

ব্যাংকগুলোর জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নতুন নির্দেশনা

বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা বাজারে ডলারের প্রবাহ বাড়াতে নতুন সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। রপ্তানি আয়ের অর্থ দেশে আসার পর তা দিয়ে প্রথমে ব্যাংকের দায় শোধ করতে হবে। এরপর রপ্তানিকারকের নির্ধারিত রিটেনশন কোটার ডলার রেখে বাকি অর্থ এক মাসের মধ্যে টাকায় রূপান্তর করতে হবে। এক মাসের মধ্যে রূপান্তর না হলে ব্যাংক নিজ উদ্যোগে সেই ডলার ব্যবহারের সুযোগ পাবে।

এই সিদ্ধান্তের ফলে রপ্তানিকারকদের ডলার ধরে রাখার প্রবণতা কমবে এবং বাজারে ডলারের সরবরাহ বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করা হচ্ছে।

নতুন নির্দেশনার পটভূমি

বর্তমানে রপ্তানিকারকরা তাদের রপ্তানি আয় দীর্ঘ সময় ধরে রাখার কারণে বাজারে পর্যাপ্ত ডলারের সরবরাহ নিশ্চিত হচ্ছে না। যদিও বাংলাদেশে রেমিটেন্স প্রবাহ ইতিবাচক রয়েছে, তবে ডলারের সংকটের কারণে ব্যাংকগুলো আমদানির জন্য প্রয়োজনীয় এলসি (লেটার অব ক্রেডিট) খোলার ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক মনে করছে, রপ্তানিকারকরা যখন ডলার জমা রেখে বাজারে সংকট সৃষ্টি করেন, তখন আমদানিকারকদের জন্য ডলার পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। ফলে আমদানি ব্যয় বেড়ে যায়, যা সামগ্রিকভাবে দেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

নতুন নীতির মূল দিকনির্দেশনা

১. ব্যাংকের দায় শোধে অগ্রাধিকার: রপ্তানি আয় দেশে আসার পর প্রথমে ব্যাংক ব্যাক-টু-ব্যাক এলসির দেনা পরিশোধ করবে। এরপর অন্যান্য ব্যাংক দায় শোধ করা হবে।

  1. রপ্তানিকারকের রিটেনশন কোটা: প্রতিটি রপ্তানিকারক নির্দিষ্ট পরিমাণ ডলার সংরক্ষণ করতে পারবেন, যা তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যবহার করা যাবে।
  2. বাড়তি ডলারের ব্যবস্থাপনা: রপ্তানিকারকের নির্ধারিত রিটেনশন কোটার বাইরে যে ডলার থাকবে, তা যদি ৩০ দিনের মধ্যে গ্রাহক খরচ না করেন, তাহলে ব্যাংক নিজ উদ্যোগে ওই ডলারের সমপরিমাণ টাকা গ্রাহকের হিসাবে জমা করে ডলার অন্যত্র ব্যবহার করতে পারবে।
  3. বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনে শিথিলতা: কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অপর এক নির্দেশনায় বলা হয়েছে, ব্যাংকগুলো এখন থেকে প্রতিটি লেনদেনের সময় বৈদেশিক মুদ্রার দর পরিবর্তন করতে পারবে।

নতুন নীতির সম্ভাব্য প্রভাব

১. ডলারের প্রবাহ বৃদ্ধি

এই নীতির ফলে বাজারে ডলারের সরবরাহ বাড়বে, যা আমদানির ব্যয় কমাতে সহায়ক হবে। বিশেষ করে ভোগ্যপণ্য আমদানিতে সহজতর পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে।

২. রপ্তানিকারকদের ডলার ধরে রাখার প্রবণতা কমবে

বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি রোধ করার জন্য রপ্তানিকারকদের নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ডলার রূপান্তর করতে হবে। এক মাসের মধ্যে ডলার বিক্রি না করলে ব্যাংক নিজ থেকেই তা ব্যবহার করবে, যা রপ্তানিকারকদের ডলার জমিয়ে রাখার প্রবণতা কমাবে।

৩. আমদানির জন্য এলসি খোলার সুবিধা বাড়বে

ডলারের সংকট কমলে আমদানিকারকদের জন্য এলসি খোলার সুযোগ বাড়বে। এতে খাদ্যপণ্য, জ্বালানি, কাঁচামালসহ গুরুত্বপূর্ণ পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে সুবিধা পাওয়া যাবে।

৪. কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ সহজতর হবে

এই নিয়ম কার্যকর হলে বাংলাদেশ ব্যাংক ডলার লেনদেনের বাজারে আরও কার্যকরভাবে হস্তক্ষেপ করতে পারবে, যা বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখতে সহায়ক হবে।

ব্যাংকারদের প্রতিক্রিয়া

নতুন নীতির বিষয়ে ব্যাংক কর্মকর্তারা ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। কয়েকজন ব্যাংকারের মতে, “এই সিদ্ধান্ত বাজারে ডলার সরবরাহ বাড়াবে এবং আমদানিকারকদের সুবিধা দেবে। তবে দীর্ঘমেয়াদে এটি কতটা কার্যকর হবে, তা দেখার বিষয়।”

অন্যদিকে, কিছু অর্থনীতিবিদের মতে, রপ্তানিকারকরা যদি এই নীতির কারণে ব্যবসায়িক ক্ষতির শিকার হন, তাহলে তারা ডলার আয় দেশে আনতে আগ্রহ হারাতে পারেন।

বিশেষজ্ঞদের মতামত

বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির এক গবেষক বলেন, “এই নীতির ফলে আমদানি ও রপ্তানির মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা সহজতর হবে। তবে রপ্তানিকারকদের উদ্বেগও গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করা প্রয়োজন।”

অপর এক বিশ্লেষক বলেন, “বাংলাদেশ ব্যাংক যদি পর্যাপ্ত নজরদারি রাখে, তাহলে এই সিদ্ধান্ত বাজারের স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে ভূমিকা রাখবে।”

উপসংহা

বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন নীতির ফলে বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে স্থিতিশীলতা আসবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। রপ্তানিকারকদের ডলার জমিয়ে রাখার প্রবণতা কমলে বাজারে ডলারের সরবরাহ বৃদ্ধি পাবে এবং আমদানিকারকদের জন্য সুবিধা তৈরি হবে।

তবে এই নীতি বাস্তবায়নে কার্যকর মনিটরিং প্রয়োজন, যাতে রপ্তানিকারকরা ব্যবসায়িকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না হন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই নীতির কার্যকারিতা স্পষ্ট হবে এবং ভবিষ্যতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রয়োজনে আরও পরিবর্তন আনতে পারে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button