বানিজ্য

নভেম্বরে মূল্যস্ফীতি ৮.২৯%: খাদ্যপণ্যের দামে প্রভাব

Advertisement

নভেম্বরে বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি ৮.২৯ শতাংশ এ পৌঁছেছে, যা অক্টোবর মাসের ৮.১৭ শতাংশের তুলনায় সামান্য বেড়েছে। গত বছরের একই সময়ে অর্থাৎ ২০২৪ সালের নভেম্বরে মূল্যস্ফীতি ছিল ১১.৩৮ শতাংশ, যা দেখায় দেশে ধীরে ধীরে মূল্যস্ফীতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসছে।

এই তথ্য প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি বছরের নভেম্বরে খাদ্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে, যদিও সবজির ভরা মৌসুমে সাধারণত খাদ্যপণ্যের দাম কিছুটা কমার প্রবণতা থাকে।

খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি ও জীবনযাত্রার ব্যয়

বিবিএসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এক মাসের ব্যবধানে খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি ৭.৩৬ শতাংশ এ দাঁড়িয়েছে, যা অক্টোবর মাসে ছিল ৭.০৮ শতাংশ। যদিও এক বছরের তুলনায় খাদ্যপণ্যের দাম কিছুটা কমে এসেছে; ২০২৪ সালের নভেম্বরে খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি ছিল ১৩.৮০ শতাংশ।

মূল্যস্ফীতি বোঝার সহজ উদাহরণ হলো: ধরুন, ২০২৪ সালের নভেম্বরে কোনো নির্দিষ্ট পণ্য বা সেবা কিনতে আপনার খরচ হয়েছিল ১০০ টাকা। এবার, ২০২৫ সালের নভেম্বরে একই পণ্য কিনতে খরচ হয়েছে ১০৮ টাকা ২৯ পয়সা। অর্থাৎ, প্রতি ১০০ টাকায় খরচ বেড়েছে ৮ টাকা ২৯ পয়সা।

এটি বোঝায়, মূল্যস্ফীতি কমে যাওয়ার মানে দাম কমে যাওয়া নয়, বরং নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে দাম বৃদ্ধি অন্যান্য সময়ের তুলনায় কিছুটা ধীরগতিতে হয়েছে।

মজুরি বৃদ্ধির তুলনা

বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী, নভেম্বর মাসে জাতীয় মজুরি বৃদ্ধির হার ৮.০৪ শতাংশ ছিল। এটি মূল্যস্ফীতির তুলনায় কম, অর্থাৎ মানুষের আয় বৃদ্ধির হার পণ্যের দাম বৃদ্ধির সঙ্গে পুরোপুরি সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মজুরি ও মূল্যস্ফীতির পার্থক্য বাড়লে গৃহস্থালী ও মধ্যবিত্তের জীবনযাত্রায় চাপ বেড়ে যায়। তাই মজুরি বৃদ্ধি এবং মূল্যস্ফীতির সমন্বয় জরুরি।

সরকারি পদক্ষেপ ও বাজার নিয়ন্ত্রণ

দেশে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এক ধরনের স্থায়ী চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে দুই-তিন বছর ধরে এই সমস্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পেয়েছে।

অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে:

  • সুদের হার বৃদ্ধি: এতে ঋণগ্রহীতাদের খরচ বেড়ে গেলে বাজারে অতিরিক্ত অর্থ প্রবাহ কমে এবং মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সাহায্য হয়।
  • নিত্যপণ্যে শুল্ক-কর হ্রাস: তেল, আলু, পেঁয়াজ, ডিমসহ কিছু নিত্যপণ্যে শুল্ক ও কর কমিয়ে বাজারে সরবরাহ বৃদ্ধি করার চেষ্টা করা হচ্ছে।
  • আমদানিপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণ: বাজারে চাহিদা অনুযায়ী পণ্যের সরবরাহ ঠিক রাখার চেষ্টা চলছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, এসব পদক্ষেপ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সাময়িকভাবে কার্যকর হলেও স্থায়ী সমাধান নয়। প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক নীতি, স্থানীয় উৎপাদন বৃদ্ধি, এবং জীবনযাত্রার ব্যয় হ্রাসের জন্য পরিকল্পিত উদ্যোগ।

মূল্যস্ফীতির প্রভাব সাধারণ মানুষের জীবনে

মূল্যস্ফীতি বাড়লে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পায়। বিশেষ করে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির জন্য এটি বড় চ্যালেঞ্জ। বাজারে চাল, ডাল, সবজি, তেল, দুধ ও ডিমের মতো প্রাথমিক খাদ্যপণ্য ক্রমশ ব্যয়বহুল হয়ে উঠছে।

  • চিকিৎসা ও শিক্ষার খরচও বেড়ে যাচ্ছে।
  • ছোট ব্যবসায়ীরা নতুন মালামাল কিনতে বেশি খরচ করছে।
  • গাড়ি, বাস, এবং নিত্যপণ্যের পরিবহন খরচ বেড়ে গেছে, ফলে অন্যান্য সেবার দামও বেড়েছে।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, দীর্ঘমেয়াদি সমাধান ছাড়া মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ কেবল সাময়িক হারে সম্ভব।

বাজার বিশ্লেষণ: কোথায় বেশি প্রভাব

বিবিএসের সাম্প্রতিক রিপোর্ট অনুযায়ী, খাদ্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যে দাম বৃদ্ধি বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়:

  • তেল ও ডিমের দাম বেড়েছে প্রায় ১০%
  • পেঁয়াজ ও আলুর দাম বেড়েছে ৮-৯%
  • সবজির দাম কিছুটা স্থিতিশীল থাকলেও নির্দিষ্ট অঞ্চলে বেড়েছে ৫-৬%

এছাড়া, অর্ধেক বা তার বেশি খরচ গৃহস্থালীর খাদ্যপণ্যে হয়। তাই খাদ্যপণ্যের দাম বৃদ্ধির প্রভাব সরাসরি মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় পড়ে।

আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট

বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি বিশ্বের অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের সঙ্গে তুলনামূলকভাবে মধ্যম সীমায় আছে। তবে বিশ্ব বাজারে তেলের দাম বৃদ্ধি, খাদ্যশস্যের চাহিদা ও সরবরাহ সমস্যা এবং বৈশ্বিক মুদ্রানীতি এই হার বাড়াতে পারে।

বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (IMF) বলছে, উন্নয়নশীল দেশে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নীতিগত স্থিতিশীলতা এবং স্থানীয় উৎপাদন বাড়ানো গুরুত্বপূর্ণ।

আগামী মাসে প্রত্যাশিত প্রভাব

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ডিসেম্বর ও জানুয়ারি মাসে কিছুটা মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি বা স্থিতিশীলতা দেখা দিতে পারে। কারণ:

  • শীতকালের চাহিদা বেড়ে যায়, বিশেষ করে তেল, ডিম, মাংস ও শাকসবজি তেমনই।
  • আমদানি ও সরবরাহের চ্যালেঞ্জ থাকতে পারে।
  • সরকারি পদক্ষেপ যেমন শুল্ক হ্রাস বা প্রণোদনা বাজারে সাময়িক প্রভাব ফেলতে পারে।

অতএব, সরকারের পরিকল্পনা ও বাজার পর্যবেক্ষণ গুরুত্বপূর্ণ।

নভেম্বর ২০২৫-এ বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি ৮.২৯ শতাংশে পৌঁছেছে, যা আগের মাসের তুলনায় সামান্য বৃদ্ধি। খাদ্যপণ্যের দাম বেড়েছে ৭.৩৬ শতাংশে, কিন্তু এক বছরের তুলনায় কমেছে। জাতীয় মজুরি বৃদ্ধির হার ৮.০৪ শতাংশ, যা মূল্যস্ফীতির তুলনায় কম।

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সুদের হার বৃদ্ধি, শুল্ক-কর হ্রাস, এবং আমদানিপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণের মতো পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। তবে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ও জীবনযাত্রায় প্রভাব এখনও লক্ষ্যণীয়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্থায়ী সমাধানের জন্য দীর্ঘমেয়াদি নীতি, স্থানীয় উৎপাদন বৃদ্ধি, খাদ্যপণ্যের সরবরাহ বৃদ্ধি ও মজুরি বৃদ্ধির সঙ্গে মূল্যস্ফীতির সমন্বয় অপরিহার্য।

MAH – 14170 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button