বানিজ্য

অস্থির পেঁয়াজের বাজার, দুই দিনের ব্যবধানে কেজিতে বেড়েছে ৫০ টাকা!

Advertisement

দেশের পেঁয়াজের বাজারে আবারও অস্থিরতা ও উত্তাপ তৈরি হয়েছে। মাত্র দুই দিনের ব্যবধানে নিত্যপ্রয়োজনীয় এই পণ্যটির দাম কেজিপ্রতি ৩০ থেকে ৪০ টাকা বেড়ে এখন খুচরা বাজারে ১৫০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। হঠাৎ করে এমন ঊর্ধ্বগতিতে সাধারণ ক্রেতারা চরম বিপাকে পড়েছেন। অনেকে বাধ্য হয়ে প্রয়োজনের তুলনায় কম (এক পোয়া বা ২৫০ গ্রাম) কিনছেন, কেউবা ক্ষোভ ঝাড়ছেন প্রশাসনের নজরদারির অভাবের ওপর। শনিবার (৬ ডিসেম্বর) সন্ধ্যায় খুলনার রূপসা ও ময়লাপোতা বাজার এবং রাজধানীর মহাখালী, মিরপুর ও কারওয়ান বাজারে খোঁজ নিয়ে এই চিত্র দেখা গেছে। এই মূল্যবৃদ্ধি দেশের সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয়ের ওপর তীব্র চাপ সৃষ্টি করেছে।

দাম বৃদ্ধির চিত্র: দুই দিনের ব্যবধানে ৪০ টাকা

খুলনা ও ঢাকার বিভিন্ন বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দুই দিনের ব্যবধানে খুচরা পর্যায়ে পেঁয়াজের দামে বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে।

  • গত সপ্তাহের দাম: গত সপ্তাহে পেঁয়াজের কেজি বিক্রি হয়েছে ১১০ থেকে ১২০ টাকা দরে।
  • গত বুধবারের দাম: খুচরা বাজারে প্রতি কেজি পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছিল ১১৫ থেকে ১২০ টাকা।
  • শুক্রবার ও শনিবারের দাম: শনিবার তা বেড়ে ১৪৫ থেকে ১৫০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।

এই হিসাবে, দুই দিনের ব্যবধানে কেজিতে বেড়েছে ৩০ থেকে ৩৫ টাকা এবং এক সপ্তাহের ব্যবধানে বেড়েছে প্রায় ৪০ টাকা। বেসরকারি চাকরিজীবী হায়দার আলী বলেন, ‘এক মাস আগে যেখানে পেঁয়াজের কেজি ছিল ৭০ থেকে ৮০ টাকা, আর আজ কিনতে হচ্ছে ১৫০ টাকা করে। দামের কারণে মাত্র এক কেজি পেঁয়াজ কিনতে হচ্ছে।’

ক্রেতাদের ক্ষোভ: প্রশাসনের নজরদারির অভাব

পেঁয়াজের এই অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির জন্য সাধারণ ক্রেতারা প্রশাসনের নজরদারির অভাবকে দায়ী করছেন। গৃহিণী নাজমুন নাহার বলেন, ‘পেঁয়াজের দাম অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। আমি কখনও এক পোয়া (২৫০ গ্রাম) পেঁয়াজ কিনিনি। আজ বাধ্য হয়ে এক পোয়া পেঁয়াজ কিনতে হচ্ছে।’

কারওয়ান বাজারে পেঁয়াজ কিনতে আসা হাসিবুল ইসলাম বলেন, ‘৩-৪ দিন আগে ১১০ টাকা কেজিতে পেঁয়াজ কিনেছি। দোকানদার এখন দাম চাচ্ছেন ১৫০ টাকা। বাজার তদারকের বিষয়ে সরকারের ন্যূনতম কোনো নজরদারি নেই। এই সুযোগেই তারা কারসাজি করে দাম বাড়াচ্ছেন।’ ক্রেতাদের মতে, যদি বাজারে নিয়মিত তদারকি থাকতো, তবে এভাবে দাম বাড়তে পারত না।

বিক্রেতাদের দাবি: সরবরাহ কমে যাওয়াই মূল কারণ

খুচরা ও পাইকারি বিক্রেতারা অবশ্য দাম বাড়ার পেছনে সরবরাহ কমে যাওয়াকে কারণ হিসেবে উল্লেখ করছেন। ময়লাপোতা কাঁচা বাজারের বিক্রেতা হাবিবুল ইসলাম বলেন, ‘দুদিন আগেও পেঁয়াজ বিক্রি করেছি ১১০-১১৫ টাকায়। সরবরাহ কমে যাওয়ায় বৃহস্পতিবার রাত থেকেই দাম বাড়ছে। শুক্রবার পেঁয়াজ বিক্রি করেছি ১৪০ টাকা দরে, আজ ১৫০ টাকায় বিক্রি করতে হচ্ছে। আড়তে সরবরাহ কম থাকায় আমাদের কাছ থেকে বেশি দাম নিচ্ছে। বাধ্য হয়ে আমাদেরও বেশি দামে পেঁয়াজ বিক্রি করতে হচ্ছে।’

কারওয়ান বাজারের পাইকারি ব্যবসায়ী বাবুল মিয়া জানান, ঢাকার বাজারে যেসব জেলা থেকে পেঁয়াজ আসে, সেসব উৎপাদন এলাকায়ও দাম বাড়ছে। তিনি বলেন, ‘দুই দিনের ব্যবধানে উৎপাদন এলাকা ফরিদপুর, রাজবাড়ী, কুষ্টিয়া ও পাবনার হাটে প্রতি মণে পেঁয়াজের দাম এক লাফে ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা বেড়েছে।’

মজুতদার ও কৃষকের কৌশল: আমদানি বন্ধের সুযোগ

ব্যবসায়ী এবং কৃষি বিশ্লেষকদের একটি অংশ মনে করেন, সরকারের আমদানি বন্ধ রাখার সিদ্ধান্তের সুযোগ নিচ্ছেন মজুতদার ও কৃষকরা। কৃষি উপদেষ্টা গত সপ্তাহে জানিয়েছিলেন, পেঁয়াজের পর্যাপ্ত মজুত আছে এবং নতুন পেঁয়াজও শিগগিরই বাজারে চলে আসবে। তাই কৃষকের স্বার্থ রক্ষায় আমদানির অনুমতি দেওয়া হচ্ছে না।

এই বক্তব্যের ফলে মজুতদার ও কৃষকরা ধারণা করছেন যে, আপাতত আমদানি করা হবে না। এই ধারণার কারণে তাঁরা ধীরগতিতে পেঁয়াজ বাজারে ছাড়ছেন, যা বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে দাম বাড়াতে সহায়তা করছে। আরেক বিক্রেতা মঞ্জুরুল বলেন, ‘ভারতের পেঁয়াজ না আসায় দাম কমছে না। এ মাসের শেষ দিকে নতুন পেঁয়াজ বাজারে চলে আসবে। আশা করছি সে সময়ে দাম কমে আসবে।’

পূর্ববর্তী অস্থিরতা ও টিসিবির তথ্য

পেঁয়াজের বাজারে এই অস্থিরতা নতুন নয়। মাসখানেক আগেও পেঁয়াজের বাজার হঠাৎ উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। তখন চার-পাঁচ দিনের ব্যবধানে পেঁয়াজের দাম ৪০ টাকার মতো বেড়ে যায়, প্রতি কেজির দর ওঠে ১১৫ থেকে ১২০ টাকায়। এরপর সরকার আমদানির অনুমতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে দর কিছুটা কমতে শুরু করে এবং ১০৫ থেকে ১১০ টাকায় নেমে আসে।

তবে টিসিবির (ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ) হিসাবে, গত বছরের তুলনায় পেঁয়াজের দর এখনও ১০ শতাংশ কম রয়েছে। কিন্তু সাধারণ ক্রেতাদের জন্য এই পরিসংখ্যান কোনো স্বস্তি নিয়ে আসেনি, কারণ তাঁদের ক্রয়ক্ষমতার সঙ্গে পেঁয়াজের দামের এই ঊর্ধ্বগতি বেমানান।

কারসাজি রোধে সরকারের পদক্ষেপ জরুরি

খুলনাসহ সারাদেশে পেঁয়াজের বাজারে দুই দিনের ব্যবধানে ৪০ টাকা মূল্যবৃদ্ধি প্রমাণ করে যে, সরবরাহ বা মজুত নিয়ে বাজারে একটি কৃত্রিম কারসাজি চলছে। সরকার ও প্রশাসনের নজরদারির অভাবের কারণেই মজুতদাররা এই সুযোগ নিচ্ছেন। সারের সংকট না থাকা এবং নতুন পেঁয়াজ বাজারে আসার পূর্বাভাসের পরও দামের এমন বৃদ্ধি কোনোভাবেই যৌক্তিক নয়। এই অস্থিরতা নিয়ন্ত্রণে আনতে সরকারকে অবিলম্বে বাজার তদারকি জোরদার করতে হবে, মজুতদারদের চিহ্নিত করে কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে এবং প্রয়োজনে দ্রুত আমদানির সিদ্ধান্ত নিতে হবে। অন্যথায়, পেঁয়াজের ঝাঁজ সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রাকে আরও কঠিন করে তুলবে।

এম আর এম – ২৫০৭, Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button