বানিজ্য

পাকিস্তান বাধা সত্ত্বেও আফগানিস্তানের রপ্তানি বৃদ্ধি $৪৫ মিলিয়ন

Advertisement

পাকিস্তানের আরোপিত নানা বাণিজ্য ও ট্রানজিট প্রতিবন্ধকতা, সীমান্তে পণ্যের আটকে থাকা, ব্যাংকিং নিষেধাজ্ঞা—সবকিছু উপেক্ষা করে অভাবনীয় উন্নতি করেছে আফগানিস্তানের রপ্তানি খাত। দেশটির জাতীয় পরিসংখ্যান ও তথ্য অধিদপ্তর (NSIA) জানিয়েছে, আফগান সৌর বর্ষে মিজান মাসে (সেপ্টেম্বর–অক্টোবর) মাত্র এক মাসে রপ্তানি বেড়েছে ৪৫ মিলিয়ন ডলার, যা দক্ষিণ এশিয়ার বর্তমান অর্থনৈতিক বাস্তবতায় উল্লেখযোগ্য সাফল্য হিসেবে দেখা হচ্ছে।

জাতীয় পরিসংখ্যান অধিদপ্তরের সোমবার প্রকাশিত সর্বশেষ প্রতিবেদনে জানানো হয়, সানবুলা মাসে (আগস্ট–সেপ্টেম্বর) আফগানিস্তানের রপ্তানি ছিল প্রায় ২৩০ মিলিয়ন ডলার। এক মাসের ব্যবধানে মিজান মাসে রপ্তানি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৭৪ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি। অর্থাৎ, পাকিস্তানের প্রবল রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক চাপে থাকা সত্ত্বেও আফগানিস্তান তার রপ্তানি প্রবৃদ্ধি বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে।

পাকিস্তানের উপর নির্ভরতা কমছে—উজবেকিস্তান, ইরান ও তুরস্কে নতুন রুট

গত দুই বছরে পাকিস্তান আফগান পণ্যের রপ্তানিতে বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা আরোপ করে।
যেমন—

  • ট্রানজিট কন্টেইনার বিলম্ব
  • ট্যাক্স বাড়ানো
  • সীমান্তে পণ্যের দীর্ঘদিন আটকানো
  • ব্যাংকিং ট্রানজেকশনে অনিয়ম ও বিলম্ব
  • আফগান ট্রাকের প্রবেশে সীমাবদ্ধতা

ফলে, দীর্ঘদিনের ঐতিহ্যবাহী কারাচি বন্দরের উপর আফগানিস্তানের নির্ভরতা ধীরে ধীরে কমতে থাকে।

আফগান সরকার নতুন রপ্তানি রুট হিসেবে এখন গুরুত্ব দিচ্ছে—

  • ইরানের চাবাহার বন্দর
  • তুর্কমেনিস্তান–উজবেকিস্তান ট্রানজিট লাইন
  • তুরস্ক হয়ে ইউরোপে লজিস্টিক করিডর
  • সংযুক্ত আরব আমিরাতের জেবেল আলি বন্দর

এগুলো পাকিস্তানের বিকল্প হিসেবে দ্রুত জনপ্রিয় হচ্ছে। আফগান রপ্তানিকারকরা জানান, এসব রুট অপেক্ষাকৃত নিরাপদ, খরচ সামান্য বেশি হলেও পণ্য আটকে থাকে না।

প্রতিবেদন কী বলছে?—সংখ্যায় আফগানিস্তানের নতুন অর্থনৈতিক চিত্র

জারি করা প্রতিবেদনে জাতীয় পরিসংখ্যান অধিদপ্তর জানায়—

সানবুলায় রপ্তানি: ২২৯.৮ মিলিয়ন ডলার
মিজানে রপ্তানি: ২৭৪.৯ মিলিয়ন ডলার
রপ্তানি বৃদ্ধি: ৪৫.১ মিলিয়ন ডলার

সবচেয়ে বেশি রপ্তানি হয়েছে—

  1. তুরস্ক
  2. সংযুক্ত আরব আমিরাত
  3. পাকিস্তান নিজেই (প্রতিবন্ধকতা থাকা সত্ত্বেও)

রপ্তানির প্রধান পণ্যসমূহ—

  • শুকনা ফল (কিশমিশ, বাদাম, পেস্তা)
  • কাঠ ও কয়লা
  • কৃষিপণ্য
  • কার্পেট
  • খনিজ পণ্য
  • জাফরান (বিশ্বে জনপ্রিয় আফগান জাফরান এখন ইরানকেও চ্যালেঞ্জ করছে)

আমদানি কমছে—স্বয়ংসম্পূর্ণ আফগানিস্তান ভিশনের প্রভাব

ইমারাতে ইসলামিয়া আফগানিস্তান গত দুই বছর ধরে “স্বয়ংসম্পূর্ণ আফগানিস্তান ভিশন” বাস্তবায়ন করছে।
এর লক্ষ্য—

  • বিদেশি পণ্যের উপর নির্ভরতা কমানো
  • দেশীয় উৎপাদন বৃদ্ধি
  • শিল্পায়নে বিনিয়োগ বাড়ানো
  • খাদ্য, কৃষিপণ্য ও ভোক্তা সামগ্রী স্থানীয়ভাবে উৎপাদন

প্রতিবেদন অনুযায়ী—
সানবুলায় আমদানি: ১.২৩২ বিলিয়ন ডলার
মিজানে আমদানি: ১.১৬৮ বিলিয়ন ডলার
হ্রাস: ০.০৬৪ বিলিয়ন ডলার

অর্থাৎ, এক মাসে প্রায় ৬৪ মিলিয়ন ডলার কম আমদানি করেছে আফগানিস্তান।

এটি আফগান সরকারের নতুন অর্থনৈতিক পরিকল্পনার অগ্রগতিকে নির্দেশ করে।

সরকারি মুখপাত্রের বক্তব্য

পরিসংখ্যান দপ্তরের মুখপাত্র হালিম রাফি বলেন—
“১৪০৪ সন অনুযায়ী সানবুলায় আমাদের মোট রপ্তানি ছিল ২২৯.৮ মিলিয়ন ডলার। মিজানে এই রপ্তানি বেড়ে হয়েছে ২৭৪.৯ মিলিয়ন ডলার। পাকিস্তানের বাধা সত্ত্বেও আমাদের অর্থনীতি সঠিক পথে এগোচ্ছে।”

তিনি আরও বলেন, রপ্তানিতে এই প্রবৃদ্ধি প্রমাণ করে যে আফগান বাণিজ্য আর শুধু একটি দেশের উপর নির্ভরশীল নয়, এখন আন্তর্জাতিক বাজারের দরজা আরও উন্মুক্ত হচ্ছে।

আফগান চেম্বার অফ এগ্রিকালচার অ্যান্ড লাইভস্টকের বিশ্লেষণ

চেম্বারের নির্বাহী পরিচালক ওয়াসিম সাফি মনে করেন—

  • আফগান কৃষিপণ্য বিশ্ববাজারে অত্যন্ত সম্ভাবনাময়
  • কিন্তু সঠিক প্রক্রিয়াকরণ ও প্যাকেজিং না থাকায় অনেক দেশে প্রবেশ করতে বাধা সৃষ্টি হয়

তার ভাষায়—
“আমাদের শুধু পাকিস্তান বা প্রতিবেশী দেশেই নয়, ইউরোপ ও আমেরিকার মতো বড় বাজারেও প্রবেশ করতে হবে। এজন্য শুরু থেকেই পণ্যের গুণমান বজায় রেখে আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে প্রক্রিয়াকরণ জরুরি।”

চেম্বারের সুপারিশ—

  • কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াকরণ ফ্যাক্টরি
  • কোল্ড স্টোরেজ
  • আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে প্যাকেজিং
  • রপ্তানিকারকদের জন্য সহজ ঋণ
  • বাণিজ্য চুক্তি সম্প্রসারণ

পাকিস্তানের বাধা: আফগান রপ্তানির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ

২০২৩ সাল থেকে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের সম্পর্ক অস্থিতিশীল।
এতে মূল কারণ—

  • সীমান্ত উত্তেজনা
  • রাজনৈতিক সম্পর্কের অবনতি
  • নিরাপত্তাজনিত অভিযোগ
  • করাচি বন্দরের নিয়মিত স্থবিরতা
  • পাকিস্তানের কঠোর নীতি

ফলে—
✔ শত শত ট্রাক তোখাম, চমন ও তুরখামে আটকায়
✔ পচনশীল পণ্যে ক্ষতি হয়
✔ রপ্তানিকারীরা লাখ লাখ ডলার লোকসান গুনতে বাধ্য হয়
✔ ব্যাংকিং লেনদেন বিলম্বিত হয়

তবে এসবের মধ্যেই আফগানিস্তান যে রপ্তানি বাড়িয়েছে—এটি দেশটির জন্য একটি বড় সাফল্য বলে আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন।

আন্তর্জাতিক বাজারে আফগান পণ্যের চাহিদা বাড়ছে

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আফগান পণ্যের প্রতি নতুন আগ্রহ দেখা যাচ্ছে।
বিশেষ করে—

  • আফগান জাফরান
  • বাদাম
  • শুকনা ফল
  • কার্পেট

জাতিসংঘ বাণিজ্য সংস্থা (UNCTAD) বলেছে, আফগানিস্তানের কৃষিপণ্য ইউরোপে উচ্চমানের হিসেবে বিবেচিত হয়। তুরস্ক এবং আমিরাত আফগান রপ্তানির নতুন ‘হাব’ হিসেবে কাজ করছে।

ইউরোপে আফগান জাফরানের জনপ্রিয়তা ইতোমধ্যেই ইরানের বাজারকে প্রভাবিত করছে।

কেন পাকিস্তানের বাধা সত্ত্বেও রপ্তানি বাড়ছে? (বিশ্লেষণ)

১. নতুন রুটের ব্যবহার

ইরান, উজবেকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান হয়ে নতুন ট্রানজিট করিডর সক্রিয় হয়েছে।

২. আফগানিস্তানে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি

গত দুই বছরে কৃষিখাতে বড় পরিবর্তন এসেছে—

  • পানির ব্যবহার দক্ষতা
  • নতুন বীজ
  • কৃষি ভর্তুকি
  • বাগান সম্প্রসারণ

৩. মধ্যপ্রাচ্যে আফগান পণ্যের পরিচিতি বৃদ্ধি

সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব, কাতার—এ দেশগুলো এখন আফগান শুকনা ফল নিয়মিত আমদানি করে।

৪. রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা (অভ্যন্তরীণ)

দেশের ভেতরে ক্রাইম রেট কমে যাওয়ায় পরিবহন ও লজিস্টিক খরচ কমেছে।

৫. কার্পেট শিল্পের পুনর্জাগরণ

আফগানিস্তানের ঐতিহ্যবাহী হাতে বোনা কার্পেট আবারও আন্তর্জাতিক বাজারে ফিরে আসছে।

সমস্যা রয়ে গেছে যেগুলো—

যদিও উন্নতি হয়েছে, তবে বড় কিছু চ্যালেঞ্জ এখনো আছে—

  • আন্তর্জাতিক ব্যাংকিং নিষেধাজ্ঞা
  • বৈদেশিক মুদ্রার সংকট
  • বিশ্ববাজারের প্রতিযোগিতা
  • পণ্যের স্ট্যান্ডার্ডাইজেশন
  • আধুনিক প্রযুক্তির অভাব
  • রপ্তানিকারকদের প্রশিক্ষণের ঘাটতি

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই সমস্যাগুলোর সমাধান হলে আফগানিস্তানের বার্ষিক রপ্তানি ১০ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত যেতে পারে।

ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা: কোন ক্ষেত্রগুলো এগিয়ে নিতে পারে আফগান রপ্তানি?

আফগান সরকার যে ৩টি খাতকে রপ্তানির প্রধান চালিকাশক্তি হিসেবে দেখছে—

১. কৃষিপণ্য ও শুকনা ফল

বিশ্ববাজারে আফগান বাদাম, কিশমিশের চাহিদা খুবই বেশি।

২. খনিজ সম্পদ

লিথিয়াম, কপার, আয়রন—এসব খনিজের বিশাল ভাণ্ডার রয়েছে দেশটিতে।

৩. কার্পেট ও হস্তশিল্প

আফগান হাতে বোনা কার্পেট আন্তর্জাতিকভাবে প্রিমিয়াম পণ্য।

পাকিস্তানের প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও আফগানিস্তানের রপ্তানি এক মাসে ৪৫ মিলিয়ন ডলার বৃদ্ধি পাওয়া শুধু অর্থনৈতিক সাফল্য নয়—এটি দেশের ভবিষ্যৎ বাণিজ্য স্বাধীনতার বার্তা বহন করে।

তুরস্ক, আমিরাত, ইউরোপের নতুন বাজার এবং পাকিস্তানের বাইরের বিকল্প রুট আফগান রপ্তানিকে নতুন দিগন্ত উন্মুক্ত করেছে। যদিও চ্যালেঞ্জ রয়েছে, তবে আফগানিস্তান যদি তার ‘স্বয়ংসম্পূর্ণ ভিশন’ সফলভাবে বাস্তবায়ন করতে পারে, তাহলে আগামী কয়েক বছরে দেশটি দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম দ্রুত বর্ধনশীল রপ্তানি অর্থনীতি হতে পারে—এমনটাই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

MAH – 13874 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button