ভারত এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য সম্পর্ক নতুন মোড় নিতে চলেছে। সম্প্রতি ভারতীয় পেট্রোলিয়াম ও প্রাকৃতিক গ্যাস মন্ত্রী হারদ্বীপ সিং পুরি ঘোষণা করেছেন, ভারত যুক্তরাষ্ট্র থেকে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (LPG) আমদানি শুরু করবে। এটি দুই দেশের মধ্যে প্রথম কাঠামোগত এলপিজি চুক্তি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্র–ভারত বাণিজ্য সম্পর্কের প্রেক্ষাপট
ভারত দীর্ঘদিন ধরে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর চেষ্টা করে আসছে। ভারতের বিপুল চাহিদার কারণে দেশের জ্বালানি খাতে রাশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য এবং অন্যান্য অঞ্চলের ওপর নির্ভরতা রয়েছে। কিন্তু সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে ভারতকে মার্কিন বাজারের দিকে আরও মনোযোগ দিতে হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্য চুক্তি এখনো সম্পূর্ণরূপে সই হয়নি। এর প্রধান কারণ হলো ক্রমবর্ধমান বাণিজ্য ঘাটতি এবং দুই দেশের মধ্যে শুল্ক ও বাণিজ্য শর্ত নিয়ে চলমান সমঝোতার জটিলতা।
নতুন চুক্তি: ভারতের লক্ষ্য ও পরিকল্পনা
হারদ্বীপ সিং পুরি সোমবার এক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম পোস্টে জানান, ভারতের রাষ্ট্রায়ত্ত তেল কোম্পানিগুলো এক বছরের জন্য যুক্তরাষ্ট্র থেকে মোট ২২ লাখ টন এলপিজি আমদানি করবে। মন্ত্রী এ চুক্তিকে ‘ঐতিহাসিক প্রথম’ চুক্তি হিসেবে আখ্যা দেন।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ভারত মূলত এলপিজি আমদানির উৎস বহুমুখী করতে এই পদক্ষেপ নিয়েছে। বর্তমানে ভারতের এলপিজি আমদানি প্রধানত মধ্যপ্রাচ্য থেকে হয়। যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি শুরু করলে এলপিজি সরবরাহের নিরাপত্তা বৃদ্ধি পাবে এবং বাণিজ্য ঘাটতি হ্রাসের ক্ষেত্রে একটি সামান্য ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।
বর্তমানে ভারত বছরে ২০–২১ মিলিয়ন টন এলপিজি আমদানি করে। বর্তমান বাজারমূল্য অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্র থেকে এর ১০ শতাংশ আমদানিতে প্রায় ১০০ কোটি ডলারের খরচ হবে।
মার্কিন প্রেসিডেন্টের অবস্থান ও ভারতীয় শুল্ক চাপ
গত কয়েক বছরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ভারতের ওপর বিভিন্ন শুল্ক আরোপ করেছেন। তার মধ্যে রয়েছে ২৫ শতাংশ পাল্টা শুল্ক এবং রাশিয়ার তেল কেনার কারণে আরোপিত ২৫ শতাংশ শাস্তিমূলক শুল্ক।
ট্রাম্প সময়ে সময়ে ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ককে ‘একপক্ষীয় বিপর্যয়’ আখ্যা দেন। তবে ভারতের পক্ষ থেকে আশ্বাস দেওয়া হয়েছে, আগামী বছরগুলোতে ভারত–যুক্তরাষ্ট্র জ্বালানি বাণিজ্য আরও বাড়ানো হবে। সম্প্রতি ট্রাম্প ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে ‘আমার বন্ধু’ এবং ‘মহান মানুষ’ হিসেবে উল্লেখ করেন, যা দুই দেশের সম্পর্কের নরম সুর প্রতিফলিত করে।
রাশিয়ার তেল আমদানিতে পরিবর্তন
বিশ্বজুড়ে তেল ও জ্বালানি–বাণিজ্যের তথ্য বিশ্লেষণকারী প্রতিষ্ঠান কেবলার জানিয়েছে, ১৭ নভেম্বর পর্যন্ত ভারত রাশিয়া থেকে ব্যাপক পরিমাণে অপরিশোধিত তেল ক্রয় করছে। অক্টোবর মাসে দৈনিক ১৬ লাখ ব্যারেল তেল আমদানি করা হয়েছে। বর্তমানে দৈনিক ক্রয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৮ লাখ ৫০ হাজার ব্যারেল।
কিন্তু ভারত মার্কিন চাপের প্রভাবে রাশিয়ার তেল আমদানির পরিমাণ কমানোর চেষ্টা করছে। জাপানি বিনিয়োগ ব্যাংক নোমুরার তথ্য অনুযায়ী, ভারত দৈনিক প্রায় ৫০ লাখ ব্যারেল কাঁচা তেল আমদানি করে। রাশিয়ার তেল ছাড় কমে আসায় এবং মার্কিন চাপের কারণে এটি মোট আমদানের ৩৫ শতাংশ থেকে কমে ১৫ শতাংশে নেমে আসবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
চুক্তির সম্ভাব্য প্রভাব
ভারতীয় সরকারি কর্মকর্তারা জানান, ভারত–যুক্তরাষ্ট্র দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তির (BTA) প্রথম ধাপ শিগগিরই সম্পন্ন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এই ধাপে মূলত শুল্ক সম্পর্কিত সমস্যা সমাধান হবে।
চুক্তি কার্যকর হলে ভারতের ওপর ২৫ শতাংশ শাস্তিমূলক শুল্কের সমস্যা সমাধান হবে। এটি দুই দেশের বাণিজ্য সম্পর্ককে আরও মজবুত করবে এবং ভারতের জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে।
অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রভাব
১. বাণিজ্য ঘাটতি হ্রাস: যুক্তরাষ্ট্র থেকে এলপিজি আমদানির ফলে ভারত–যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতি সামান্য হলেও হ্রাস পাবে।
২. জ্বালানি নিরাপত্তা: ভারত রাশিয়ার তেলের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা কমিয়ে মার্কিন উৎস থেকে এলপিজি আমদানি করে জ্বালানি নিরাপত্তা বৃদ্ধি করবে।
৩. রাজনৈতিক সম্পর্কের সুর নরম করা: ট্রাম্প ও মোদির বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক এবং চুক্তি বাস্তবায়ন দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ককে আরও মজবুত করবে।
৪. বাজারের স্থিতিশীলতা: এলপিজি সরবরাহের বৈচিত্র্য বজায় রাখলে ভারতীয় বাজারে দাম এবং সরবরাহের স্থিতিশীলতা বাড়বে।
আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট
বিশ্বের প্রধান তেল উৎপাদক দেশগুলো এবং আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি মূল্যবৃদ্ধি ভারতকে নতুন উৎস খুঁজতে প্ররোচিত করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি শুধু এলপিজি নয়, অন্যান্য জ্বালানি ও শিল্প পণ্যের জন্যও পথপ্রদর্শক হতে পারে।
বিশেষজ্ঞদের মতামত
জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ভারত–যুক্তরাষ্ট্র চুক্তি এলপিজি আমদানি বহুমুখীকরণের ক্ষেত্রে একটি বড় পদক্ষেপ। এটি ভারতীয় অর্থনীতি ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ভারসাম্য বজায় রাখতে সহায়ক হবে।
ভারত এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার এই নতুন চুক্তি দুই দেশের সম্পর্কের একটি ইতিবাচক দিক তুলে ধরছে। এলপিজি আমদানি বহুমুখীকরণের মাধ্যমে ভারত জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারবে এবং বাণিজ্য ঘাটতি হ্রাসে ভূমিকা রাখবে। শিগগিরই চুক্তি সই হলে এটি দুই দেশের অর্থনীতি এবং কূটনৈতিক সম্পর্কের জন্য নতুন দিগন্ত খুলে দেবে।
MAH – 13859 I Signalbd.com



