কৃষক থেকে ভোক্তা পর্যন্ত এক নতুন সেতুবন্ধন
বাংলাদেশে প্রতিদিন বাজারে গেলে একটাই অভিযোগ শোনা যায়—সবজির দাম আকাশছোঁয়া। কৃষক মাঠে যে সবজি ফলান, সেটি শহরে পৌঁছাতে পৌঁছাতে দাম দ্বিগুণ কিংবা তিনগুণ হয়ে যায়। এর ফলে যেমন ভোক্তা ক্ষতিগ্রস্ত হন, তেমনি কৃষকও তার ন্যায্য দাম পান না। এই দীর্ঘদিনের সমস্যার সমাধান খুঁজতে দেশের সবচেয়ে বড় রিটেইল চেইন শপ ‘স্বপ্ন’ এবার এক অনন্য উদ্যোগ নিয়েছে—সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে সবজি কিনে ক্রেতাদের হাতে পৌঁছে দেওয়া ন্যায্যমূল্যে।
এই উদ্যোগের মূল লক্ষ্য—কৃষককে তার পরিশ্রমের সঠিক মূল্য দেওয়া এবং ভোক্তাকে ন্যায্যমূল্যে তাজা ও মানসম্মত সবজি সরবরাহ করা।
স্বপ্নের উদ্যোগ: কৃষকের ঘরে স্বস্তি, ভোক্তার বাজারে সাশ্রয়
‘স্বপ্ন’ কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, বর্তমানে তারা মানিকগঞ্জ, বগুড়া, নাটোর, টাঙ্গাইল, কুমিল্লা ও সিরাজগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন জেলার কৃষকদের কাছ থেকে সরাসরি সবজি ক্রয় করছে।
এই পদ্ধতিতে মধ্যস্বত্বভোগীর ভূমিকা নেই বললেই চলে। ফলে একদিকে কৃষক তার উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য দাম পাচ্ছেন, অন্যদিকে শহরের ক্রেতারা সাশ্রয়ী মূল্যে তাজা সবজি কিনতে পারছেন।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ২৯ ও ৩০ অক্টোবর ‘স্বপ্ন’-এর আউটলেটগুলোতে এক কেজি পটল বিক্রি হয়েছে মাত্র ২৯ টাকায়, যেখানে খোলা বাজারে সেই একই পটলের দাম ৬০ থেকে ৮০ টাকা পর্যন্ত।
এছাড়াও,
- লাউ বিক্রি হচ্ছে ৩৫ টাকা কেজি,
- মিষ্টি কুমড়া ৪৫ টাকা,
- ঢেঁড়স ৫৫ টাকা,
- করলা ৫৫ টাকা,
- শিম ৬০ টাকা,
যা খোলা বাজারের চেয়ে অনেক কম।
কেন এমন দাম পার্থক্য?
বাংলাদেশের কৃষিপণ্যের বাজারব্যবস্থা দীর্ঘদিন ধরেই একাধিক স্তরের মধ্যস্বত্বভোগীর মাধ্যমে পরিচালিত হয়ে আসছে।
কৃষক তার ফসল বিক্রি করেন পাইকারকে, পাইকার বিক্রি করেন আড়তদার বা পরিবেশকের কাছে, তারপর সেই পণ্য খুচরা বাজারে আসে।
এই পর্যায়ে পরিবহন, সংরক্ষণ, কমিশন এবং মুনাফার পরিমাণ যোগ হতে হতে সবজির দাম কয়েকগুণ বেড়ে যায়।
‘স্বপ্ন’ এই চক্রটি ভেঙে সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে পণ্য ক্রয় করছে। এর ফলে পণ্যের দাম অনেকটা কমিয়ে আনা সম্ভব হচ্ছে এবং কৃষকরাও পাচ্ছেন তাদের ন্যায্য মূল্য।
কৃষকের কণ্ঠে স্বপ্নের গল্প
মানিকগঞ্জের কৃষক মো. রবিউল ইসলাম বলেন,
“আগে আমাদের ফসল বিক্রি করতে আড়তদারের কাছে যেতে হতো। দাম যেটাই দিত, সেটাই নিতে হতো। এখন স্বপ্নের লোকজন মাঠে এসে সরাসরি কিনে নিচ্ছে। এতে সময়ও বাঁচছে, আবার লাভও হচ্ছে বেশি।”
বগুড়ার এক নারী কৃষক রুমা খাতুন বলেন,
“আমরা নিজেদের চাষ করা সবজি বিক্রি করছি এমন এক প্রতিষ্ঠানের কাছে, যারা দাম কমায় না, বরং মান অনুযায়ী দাম দেয়। এই উদ্যোগটা সত্যিই কৃষকদের জন্য আশীর্বাদ।”
ভোক্তার মুখে সন্তুষ্টি
ঢাকা শহরের গুলশান এলাকার ক্রেতা তানিয়া হক বলেন,
“আগে বাজারে গিয়ে সবজি কিনতে ভয় লাগত, দাম এত বেশি! এখন স্বপ্ন থেকে কিনতে পারছি অনেক কম দামে, আবার পণ্যও তাজা। সবচেয়ে ভালো লাগে—এটা জানলে যে এই টাকাটা সরাসরি কৃষকের কাছেই যাচ্ছে।”
এমন প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জের অনেক ক্রেতার কাছ থেকেও।
অফার কোথায় পাওয়া যাবে
বর্তমানে ‘স্বপ্ন’-এর এই বিশেষ সবজি অফারটি ঢাকা, কুমিল্লা, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জ জোনের আউটলেটে পাওয়া যাচ্ছে।
তবে কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, এই উদ্যোগ সফল হলে ভবিষ্যতে এটি চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী ও রংপুর অঞ্চলেও চালু করা হবে।
এই অফার স্টক থাকা সাপেক্ষে প্রযোজ্য।
স্বপ্নের লক্ষ্য: টেকসই কৃষি ও ন্যায্যমূল্যের বাজার গঠন
স্বপ্নের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (MD) সৈয়দ নাসিম মান্নান বলেছেন,
“আমরা চাই কৃষক হাসুক, ক্রেতাও হাসুক। তাই আমরা মধ্যস্বত্বভোগীদের বাদ দিয়ে কৃষক থেকে সরাসরি পণ্য কিনছি। এতে কৃষকের আয় বাড়ছে, আবার ভোক্তাও পাচ্ছেন সাশ্রয়ী দামে মানসম্মত পণ্য।”
তিনি আরও জানান, ভবিষ্যতে শুধু সবজি নয়, চাল, ডাল, ডিম, দুধ, ফল, এমনকি মাছের ক্ষেত্রেও সরাসরি কৃষক বা উৎপাদক থেকে সংগ্রহ করার পরিকল্পনা রয়েছে।
বাংলাদেশের কৃষি খাতে ইতিবাচক পরিবর্তনের ইঙ্গিত
এই ধরনের উদ্যোগ বাংলাদেশের কৃষি অর্থনীতিতে বড় পরিবর্তন আনতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. রুহুল আমিন বলেন,
“যদি বড় খুচরা বিক্রেতারা সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে ক্রয় শুরু করে, তাহলে বাজারে প্রতিযোগিতা বাড়বে এবং মূল্য স্থিতিশীল থাকবে। এতে কৃষক লাভবান হবে, আবার সাধারণ মানুষও পাবে স্বস্তি।”
এমন উদ্যোগ শুধু ব্যবসা নয়, বরং একটি সামাজিক দায়বদ্ধতার প্রতিফলন।
ভোক্তা-বান্ধব রিটেইল চেইন হিসেবে ‘স্বপ্ন’
দেশের সবচেয়ে বড় রিটেইল চেইন ‘স্বপ্ন’ বর্তমানে ৫০টিরও বেশি জেলায় ২০০-র বেশি আউটলেট পরিচালনা করছে।
তারা শুধু ব্যবসা নয়, বরং “Eat Better, Live Better”—এই মূলমন্ত্রে বিশ্বাসী।
এর আগে স্বপ্ন ‘ফার্ম টু টেবিল’ প্রকল্পের মাধ্যমে কিছু এলাকায় কৃষকদের কাছ থেকে সরাসরি দুধ, ডিম ও ফল সংগ্রহ করে বিক্রি করেছিল, যা ব্যাপক সাড়া ফেলে।
ভবিষ্যতের পরিকল্পনা ও ডিজিটাল মার্কেটিং সংযোগ
স্বপ্ন ইতোমধ্যেই তাদের অনলাইন প্ল্যাটফর্মেও এই সবজি বিক্রি শুরু করেছে।
অ্যাপ কিংবা ওয়েবসাইটের মাধ্যমে ক্রেতারা ঘরে বসেই অর্ডার করতে পারছেন এসব সাশ্রয়ী মূল্যের পণ্য।
এছাড়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও চলছে ব্যাপক প্রচারণা—“স্বপ্ন মূল্যে স্বপ্নের সবজি, কৃষকের হাসিতে ভরুক দেশ।”
সামাজিক প্রভাব: এক ধাপে দুই সুখ
এই উদ্যোগে সবচেয়ে বেশি উপকৃত হচ্ছেন দেশের প্রান্তিক কৃষকরা।
আগে যেখানে তাদের পণ্যের দাম নির্ধারণ করতেন মধ্যস্বত্বভোগীরা, এখন সেখানে তারা নিজেরাই দাম আলোচনা করতে পারছেন।
অন্যদিকে শহরের ক্রেতারা পাচ্ছেন তাজা, মানসম্মত ও সুলভ মূল্যের সবজি—যা বর্তমান মূল্যস্ফীতির বাজারে অনেকটা স্বস্তি এনে দিয়েছে।
‘স্বপ্ন’-এর হাত ধরে পরিবর্তনের সূচনা
‘স্বপ্ন মূল্যে স্বপ্নের সবজি’—এই উদ্যোগ শুধু একটি অফার নয়, বরং বাংলাদেশের কৃষি ও বাজার ব্যবস্থায় একটি নতুন চিন্তার দরজা খুলে দিয়েছে।
যেখানে কৃষক, ভোক্তা, ব্যবসায়ী—সবাই লাভবান হচ্ছে।
যদি এই প্রকল্প দীর্ঘমেয়াদে টিকে থাকে, তাহলে একদিন হয়তো আমরা এমন বাংলাদেশ দেখব,
যেখানে বাজারে দাম নিয়ন্ত্রণে থাকবে, কৃষক ন্যায্য মূল্য পাবেন, আর ভোক্তা তাজা সবজি কিনবেন হাসিমুখে।
স্বপ্নের এই উদ্যোগ আমাদের কৃষি ও অর্থনীতির জন্য এক অনুপ্রেরণার গল্প—যা প্রমাণ করে,
সৎ ইচ্ছা আর সঠিক পরিকল্পনা থাকলে পরিবর্তন সম্ভব।
MAH – 13541 I Signalbd.com



