কর্মসংস্থান

সরকারি খাতে দৈনিকভিত্তিক শ্রমিকদের মজুরি বাড়ছে, ঢাকায় সর্বোচ্চ ৮০০ টাকা

Advertisement

সরকারি প্রতিষ্ঠানে দৈনিকভিত্তিক নিয়োজিত সাময়িক শ্রমিকদের জন্য সুখবর আনল অর্থ মন্ত্রণালয়। আগামী ১ জুলাই ২০২৫ থেকে এই শ্রমিকদের মজুরি ১৫০ টাকা থেকে ২২৫ টাকা পর্যন্ত বাড়ানো হচ্ছে। মজুরি বৃদ্ধির এই সিদ্ধান্ত ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার শ্রমজীবী মানুষের জীবনে সরাসরি প্রভাব ফেলবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ বৃহস্পতিবার (২২ মে) এক পরিপত্র জারি করে এই সিদ্ধান্তের কথা জানায়। পরিপত্রে জানানো হয়, সরকারি মন্ত্রণালয়, বিভাগ, অধিদপ্তর, দপ্তর, রাষ্ট্রায়ত্ত ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানসমূহে জরুরি প্রকল্প বা কাজের জন্য অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগপ্রাপ্ত শ্রমিকদের জন্য এ মজুরি বৃদ্ধির নির্দেশনা কার্যকর হবে।

নতুন মজুরি কাঠামো: অঞ্চলভেদে বিস্তারিত

নতুন পরিপত্র অনুযায়ী, দৈনিক মজুরি বৃদ্ধির হার ও সর্বোচ্চ পরিমাণ এলাকা অনুযায়ী ভিন্ন হবে। নিচে অঞ্চলভেদে বিস্তারিত তুলে ধরা হলো:

ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন এলাকা:

  • দক্ষ শ্রমিক: ৬০০ টাকা → ৮০০ টাকা (বৃদ্ধি: ২০০ টাকা)
  • অদক্ষ শ্রমিক: ৫৭৫ টাকা → ৮০০ টাকা (বৃদ্ধি: ২২৫ টাকা)

বিভাগীয় শহর ও অন্যান্য সিটি করপোরেশন এলাকা:

  • দক্ষ শ্রমিক: ৬০০ টাকা → ৭৫০ টাকা (বৃদ্ধি: ১৫০ টাকা)
  • অদক্ষ শ্রমিক: ৫৫০ টাকা → ৭৫০ টাকা (বৃদ্ধি: ২০০ টাকা)

জেলা ও উপজেলা এলাকা:

  • দক্ষ শ্রমিক: ৫৫০ টাকা → ৭০০ টাকা (বৃদ্ধি: ১৫০ টাকা)
  • অদক্ষ শ্রমিক: ৫০০ টাকা → ৭০০ টাকা (বৃদ্ধি: ২০০ টাকা)

কারা এই সুবিধা পাবেন?

নতুন মজুরি কাঠামো কেবলমাত্র ‘দৈনিকভিত্তিতে সাময়িক শ্রমিক নিয়োজিতকরণ নীতিমালা, ২০২৫’-এর আওতায় নিয়োজিত শ্রমিকদের জন্য প্রযোজ্য। এই নীতিমালা অনুযায়ী:

  • জন্মসূত্রে বাংলাদেশি নাগরিক;
  • বয়স ১৮ থেকে ৫৮ বছরের মধ্যে;
  • মানসিক ও শারীরিকভাবে সক্ষম;
  • সরাসরি পদ সৃষ্টি না করে অস্থায়ী ভিত্তিতে দৈনিক মজুরিতে নিয়োগপ্রাপ্ত;
  • মাসে সর্বোচ্চ ২২ দিন পর্যন্ত নিয়োগযোগ্য।

এই শ্রমিকরা দেশের সরকারি প্রকল্প, সড়ক সংস্কার, পৌরসভার পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম, বিদ্যুৎ ও পানি সরবরাহ, স্বাস্থ্যখাতসহ নানা জরুরি সেবামূলক কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত হয়ে থাকেন।

শর্তাবলি ও ব্যয় ব্যবস্থাপনা

পরিপত্রে কিছু গুরুত্বপূর্ণ শর্ত আরোপ করা হয়েছে, যেমন:

  • শ্রমিক নিয়োগ ও মজুরি প্রদান: “দৈনিকভিত্তিতে সাময়িক শ্রমিক নিয়োজিতকরণ নীতিমালা ২০২৫” অনুসরণ করতে হবে।
  • কর্মপরিবেশ: শ্রমিকদের উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।
  • মজুরি প্রদানের অনুমোদন: সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ থেকে নিয়োগ অনুমোদন নিতে হবে।
  • ব্যয় নির্বাহ: সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক বাজেট থেকে খরচ নির্বাহ করতে হবে।
  • অনিয়মের দায়: অনিয়ম ধরা পড়লে বিল অনুমোদনকারী কর্মকর্তা দায়ী থাকবেন।

মজুরি বৃদ্ধির প্রভাব: স্বস্তি নাকি সীমিত উপকার?

মজুরি বৃদ্ধিকে অনেকেই স্বাগত জানালেও বাস্তবতায় কতটা পরিবর্তন আসবে, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়ে গেছে। বাংলাদেশে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বহুগুণ বেড়েছে। ফলে এই বৃদ্ধিও অনেকের কাছে পর্যাপ্ত নয়।

তবে অর্থনীতিবিদদের মতে, এটি একটি “সাধু উদ্যোগ”, যা অন্তত প্রাথমিকভাবে সাময়িক শ্রমিকদের জীবনযাত্রা মান উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষক আরিফ মাহমুদ বলেন,

“সরকারের এই পদক্ষেপটি নি:সন্দেহে প্রশংসনীয়। তবে এটিকে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ হিসেবে নিতে হবে। কেবল মজুরি বাড়ানো নয়, তাদের জন্য সামাজিক সুরক্ষা, স্বল্পমেয়াদি প্রশিক্ষণ ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করাও জরুরি।”

সরকারি খাতে নিয়োজিত সাময়িক শ্রমিকরা কারা?

এরা হলেন সেইসব মানুষ, যারা রাস্তার গর্ত মেরামত, মেলা বা জরুরি অনুষ্ঠান আয়োজন, পৌর পরিষ্কার কার্যক্রম, জলাবদ্ধতা নিরসন, হাসপাতালের ছোটখাটো সহায়তা কাজসহ বিভিন্ন খাতে কাজ করেন। কিন্তু তারা চাকরির নিশ্চয়তা পান না।

এমনই এক শ্রমিক ফরিদপুরের মো. শহিদুল বলেন,

“দিনে ৫০০ টাকায় কাজ করে সংসার চলত না। এখন যদি ৭০০ টাকা পাই, তাহলে অন্তত বাজারে গিয়ে একটু খুশি হওয়া যাবে।”

আগামী করণীয় কী হতে পারে?

বিশেষজ্ঞ ও শ্রমিক নেতাদের মতে, সরকারকে এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের পাশাপাশি নিচের বিষয়গুলোর দিকে নজর দিতে হবে:

  1. স্থায়ী নিয়োগের সুযোগ তৈরি: দক্ষ ও অভিজ্ঞ সাময়িক শ্রমিকদের জন্য পর্যায়ক্রমে স্থায়ী পদ সৃষ্টি করা যেতে পারে।
  2. সামাজিক নিরাপত্তা: অসুস্থতা, দুর্ঘটনা বা বার্ধক্যজনিত কারণে ক্ষতিপূরণ ও সহায়তা নিশ্চিত করা।
  3. প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা উন্নয়ন: শ্রমিকদের দক্ষ করে তোলা ও দীর্ঘমেয়াদে আত্মনির্ভরশীল করে তোলার সুযোগ দেওয়া।

সরকারি খাতে সাময়িক শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি নিঃসন্দেহে একটি সময়োপযোগী এবং প্রয়োজনীয় উদ্যোগ। এই উদ্যোগে স্বল্প আয়ের হাজারো শ্রমিক সাময়িক স্বস্তি পাবেন, যা দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক ভারসাম্য বজায় রাখতে সহায়ক হতে পারে। তবে এটি যেন এককালীন না হয়ে দীর্ঘমেয়াদি কর্মপরিকল্পনার অংশ হয়, সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের আন্তরিকতা অত্যন্ত জরুরি।

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button