
চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে একটি বড় ধরনের জাহাজডুবির ঘটনা ঘটেছে। সিরামিক শিল্পের কাঁচামালবোঝাই ‘এমভি জায়ান’ নামের একটি লাইটারেজ জাহাজ শনিবার সকালে পতেঙ্গা উপকূলের কাছাকাছি এলাকায় ডুবে যায়। জাহাজটিতে প্রায় ১২০০ টন সিরামিক শিল্পের কাঁচামাল ছিল।
এই ঘটনায় কোনো প্রাণহানি ঘটেনি। জাহাজে থাকা ১৩ জন নাবিক সবাই নিরাপদে উদ্ধার হয়েছেন বলে জানিয়েছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। তবে বিশাল পরিমাণ কাঁচামাল সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গেছে এবং জাহাজটি সমুদ্রের তলায় আংশিকভাবে তলিয়ে আছে।
ঘটনার বিবরণ
বন্দর সূত্রে জানা যায়, শুক্রবার রাতে বন্দরের বহির্নোঙরে অবস্থানরত একটি মাদার ভ্যাসেল থেকে ‘এমভি জায়ান’ জাহাজটি ১২০০ টন কাঁচামাল বোঝাই করে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। এসব কাঁচামাল মূলত সিরামিক কারখানায় ব্যবহারের জন্য আমদানিকৃত ছিল।
রাতের দিকে সমুদ্রে প্রবল ঢেউয়ের মধ্যে জাহাজটিতে যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দেয়। ক্রুরা সমস্যাটি সামাল দিতে চেষ্টা করলেও ভোরের দিকে অবস্থার অবনতি ঘটে। পরে শনিবার সকালে জাহাজটি পতেঙ্গা উপকূলের দিকে নিয়ে আসা হচ্ছিল, ঠিক তখনই অন্য এক লাইটার জাহাজের সঙ্গে ধাক্কা লাগে। তাতে জাহাজের নিচের অংশ ফেটে যায় এবং দ্রুত পানিতে ভর্তি হতে থাকে।
অল্প সময়ের মধ্যেই জাহাজটি কাত হয়ে যায় ও তলিয়ে যায়। স্থানীয় জেলেরা এবং নৌবাহিনীর একটি টহল দল দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছে ক্রুদের উদ্ধার করে নিরাপদে তীরে নিয়ে আসে।
উদ্ধার অভিযান অব্যাহত
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ জানায়, জাহাজডুবির পরপরই উদ্ধার ও তেল নিঃসরণ প্রতিরোধ অভিযান শুরু হয়েছে। বন্দর ফায়ার সার্ভিস, কোস্টগার্ড, নৌবাহিনী এবং বন্দর মেরিন টিম একসাথে কাজ করছে।
বন্দর কর্তৃপক্ষের মুখপাত্র ক্যাপ্টেন শাহনেওয়াজ আহমেদ জানান,
“জাহাজটি ডুবে যাওয়ার খবর পেয়ে আমরা সঙ্গে সঙ্গে উদ্ধার দল পাঠাই। এখন পর্যন্ত কোনো প্রাণহানির খবর নেই। জাহাজটিতে থাকা সিরামিক শিল্পের কাঁচামাল পানিতে মিশে গেছে। জাহাজটি উদ্ধারের জন্য মেরিন টোইং টিম কাজ করছে।”
তিনি আরও জানান, জাহাজটির অবস্থান নির্ধারণ করা হয়েছে এবং শিগগিরই ক্রেন ও ভারী উদ্ধারযন্ত্র নিয়ে অপারেশন শুরু হবে।
প্রাথমিক তদন্তে যা জানা গেছে
প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, জাহাজটির যান্ত্রিক ত্রুটি এবং অপ্রতুল রক্ষণাবেক্ষণই দুর্ঘটনার মূল কারণ। সাম্প্রতিক সময়ে চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে এমন একাধিক দুর্ঘটনা ঘটেছে, যা দেশের সামুদ্রিক পরিবহন ব্যবস্থার দুর্বলতা ও নিরাপত্তাহীনতা তুলে ধরছে।
একজন বন্দর কর্মকর্তা বলেন,
“অনেক লাইটারেজ জাহাজ পুরনো ও অদক্ষভাবে পরিচালিত হচ্ছে। এদের বেশিরভাগেরই পর্যাপ্ত নিরাপত্তা সরঞ্জাম নেই। নিয়মিত পরিদর্শন জোরদার করা প্রয়োজন।”
বন্দর কার্যক্রমে প্রভাব
চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে একসাথে শতাধিক জাহাজ পণ্য খালাস ও বোঝাইয়ের কাজ করে। এ ধরনের দুর্ঘটনা বন্দরের কার্যক্রমে অস্থায়ী প্রভাব ফেলে। বন্দর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, দুর্ঘটনাস্থল সাময়িকভাবে নিরাপত্তা জোন ঘোষণা করা হয়েছে, যাতে অন্য জাহাজগুলো নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখতে পারে।
এছাড়া ডুবন্ত জাহাজ থেকে তেল বা অন্য কোনো পদার্থ নিঃসরণের সম্ভাবনা থাকায় পরিবেশগত ঝুঁকিও বিবেচনায় রাখা হয়েছে।
পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম শাখার এক কর্মকর্তা জানান,
“জাহাজ থেকে কোনো তেল বা বিপজ্জনক পদার্থ বের হলে তা সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর হতে পারে। তাই আমরা পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছি।”
সিরামিক শিল্পে সম্ভাব্য ক্ষতি
বাংলাদেশের সিরামিক শিল্প বর্তমানে রপ্তানিমুখী একটি বড় খাত। দেশে প্রায় ৬০টিরও বেশি কারখানা সিরামিক পণ্য উৎপাদন করে, যেগুলোর বেশিরভাগ কাঁচামাল আমদানি করা হয়।
এই জাহাজে থাকা ১২০০ টন কাঁচামাল নষ্ট হয়ে যাওয়ায় কয়েকটি কারখানা উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বাংলাদেশ সিরামিক ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (BCMEA) একজন প্রতিনিধি বলেন,
“কাঁচামালের ঘাটতি হলে উৎপাদন শিডিউলে প্রভাব পড়বে। এমন দুর্ঘটনা শিল্প খাতের জন্য বড় ক্ষতি।”
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দুর্ঘটনার ধারাবাহিকতা
চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে গত কয়েক বছরে বেশ কয়েকটি জাহাজডুবির ঘটনা ঘটেছে।
- ২০২৩ সালে কয়লাবোঝাই একটি লাইটার জাহাজ তলিয়ে যায়
- ২০২৪ সালে একটি পাথরবোঝাই জাহাজ ঢেউয়ের কবলে পড়ে ডুবে যায়
- এবার ২০২৫ সালে কাঁচামালবোঝাই ‘এমভি জায়ান’ দুর্ঘটনার শিকার হলো
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ধারাবাহিক দুর্ঘটনা সামুদ্রিক নিরাপত্তা ব্যবস্থার ঘাটতি ও পুরনো জাহাজ ব্যবহারের ঝুঁকি স্পষ্ট করছে।
সমুদ্র নিরাপত্তা জোরদারের আহ্বান
সামুদ্রিক বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন,
- পুরনো ও অননুমোদিত লাইটারেজ জাহাজ অপসারণ
- নিয়মিত পরিদর্শন ও রক্ষণাবেক্ষণ বাধ্যতামূলক করা
- নাবিকদের প্রশিক্ষণ বাড়ানো
- বন্দর এলাকার আবহাওয়ার পূর্বাভাস মনিটরিং আরও উন্নত করা
এসব ব্যবস্থা গ্রহণ করলে ভবিষ্যতে এমন দুর্ঘটনা অনেকাংশে রোধ করা সম্ভব হবে।
তদন্ত কমিটি গঠন
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, জাহাজডুবির ঘটনাটি তদন্তে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটি আগামী তিন কার্যদিবসের মধ্যে প্রাথমিক প্রতিবেদন দেবে।
বন্দর কর্তৃপক্ষ আশাবাদী, ঘটনার মূল কারণ উদঘাটন করে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
জনমনে উদ্বেগ
চট্টগ্রাম অঞ্চলের স্থানীয়রা জানাচ্ছেন, সাম্প্রতিক সময়ে সমুদ্রে নিয়মিত এমন দুর্ঘটনা ঘটায় তারা উদ্বিগ্ন। অনেক জেলে অভিযোগ করেছেন, রাতে বা ভোরে পণ্যবাহী জাহাজগুলো অন্ধকারে চলাচল করে, অনেক সময় সিগন্যাল লাইট ঠিকভাবে কাজ করে না।
স্থানীয় জেলে আব্দুল হামিদ বলেন,
“আমরা মাঝেমাঝে দেখি বড় বড় জাহাজ একে অপরের খুব কাছে চলে আসে। এতে ধাক্কা লাগার আশঙ্কা থেকেই যায়। নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও কড়া করা দরকার।”
চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে ‘এমভি জায়ান’-এর ডুবে যাওয়া শুধু একটি দুর্ঘটনা নয়, বরং বাংলাদেশের সামুদ্রিক পরিবহন খাতের জন্য একটি বড় সতর্কবার্তা। কাঁচামাল হারানো যেমন অর্থনৈতিক ক্ষতি, তেমনি নিরাপত্তা ব্যবস্থার ঘাটতি আমাদের ভবিষ্যতের ঝুঁকিও দেখিয়ে দিচ্ছে।
দেশের সবচেয়ে ব্যস্ত বন্দর চট্টগ্রামকে ঘিরে নিরাপত্তা, রক্ষণাবেক্ষণ ও টেকসই নৌপরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবি।
MAH – 13375 I Signalbd.com