
কয়েক সপ্তাহ ধরে আন্তর্জাতিক বাজারে স্বর্ণের দাম ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। সম্প্রতি প্রতি আউন্স স্বর্ণের দাম ৪,২০৯ ডলার স্পর্শ করেছে। বাংলাদেশেও এর প্রভাব পড়ে; দেশের বাজারে প্রতি ভরির ২২ ক্যারেটের স্বর্ণ বিক্রি হচ্ছে ২ লাখ ১৬ হাজার ৩৩২ টাকায়, যা ইতিহাসে সর্বোচ্চ।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই উর্ধ্বগতি অস্থায়ী নয় এবং সামনে আরও বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে প্রশ্ন হলো, হঠাৎ কী কারণে স্বর্ণের এমন চাহিদা তৈরি হয়েছে?
বৈশ্বিক বাজারে স্বর্ণের উর্ধ্বগতি
বিশ্বজুড়ে স্বর্ণের দামের বৃদ্ধির পেছনে রয়েছে নানা কারণ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সুদের হার কমানোর প্রত্যাশা, চলমান ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর ব্যাপক স্বর্ণ ক্রয় অন্যতম।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাত এবং মার্কিন-চীনের বাণিজ্য উত্তেজনা আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে স্বর্ণের দিকে ঝুঁকিয়ে দিয়েছে।
বিশ্বজুড়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো প্রতিবছর ১,০০০ টনেরও বেশি স্বর্ণ কিনছে, যা ২০১০-২০২১ সালের গড় ৪৮১ টনের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি।
নিরাপদ বিনিয়োগ হিসেবে স্বর্ণের গুরুত্ব
অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা বাড়লে বিনিয়োগকারীরা নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে স্বর্ণে বিনিয়োগ করতে শুরু করেন। অর্থনীতি দুর্বল হলে বা মুদ্রাস্ফীতি বৃদ্ধি পেলে স্বর্ণের দাম স্থিতিশীল থাকে বা আরও বৃদ্ধি পায়।
নর্থইস্টার্ন ইউনিভার্সিটির অর্থনীতিবিদ বব ট্রায়েস্ট বলেছেন, “স্বর্ণ হলো প্রাচীন ও নিরাপদ বিনিয়োগের মাধ্যম। অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার সময়ে মানুষ স্বর্ণে ঝুঁকে পড়ে। এটি মূলত নিরাপত্তা এবং স্থিতিশীলতার প্রতীক।”
দেশের বাজারে প্রভাব
বিশ্ববাজারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশে স্বর্ণের দাম বাড়ছে। বাংলাদেশ জুয়েলার্স অ্যাসোসিয়েশন সম্প্রতি দাম বাড়িয়েছে, যেখানে ২২ ক্যারেটের প্রতি ভরির দাম ২ লাখ ১৬ হাজার ৩৩২ টাকায় পৌঁছেছে। ২১ ক্যারেট এবং ১৮ ক্যারেটের স্বর্ণও অনুরূপভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নও স্বর্ণের দাম বাড়ানোর একটি প্রধান কারণ। ২০২১ অর্থবছর থেকে এখন পর্যন্ত টাকার মান মার্কিন ডলারের তুলনায় প্রায় ৪৩ শতাংশ কমেছে। এছাড়া দেশে স্বর্ণের চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম। অনেক স্বর্ণ ভারতে পাচার হওয়ার কারণে বাজারে ঘাটতি তৈরি হয়।
চাহিদা বনাম সরবরাহ
বাংলাদেশে প্রতিবছর ২০-৪০ টন স্বর্ণের চাহিদা থাকে। কিন্তু সরবরাহ সীমিত। দেশীয় বাজারে আসা স্বর্ণের বড় অংশ অনানুষ্ঠানিকভাবে আসে, যা বিয়ের মৌসুম ও উৎসবে চাহিদা আরও বাড়ায়। এই ভারসাম্যহীনতার কারণে স্বর্ণের দাম প্রাকৃতিকভাবেই বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বিশেষ করে উৎসব ও বিয়ের মৌসুমে স্বর্ণের চাহিদা বৃদ্ধি পেলে বাজারে ঘাটতি আরও প্রকট হয়। ব্যবসায়ীরা মনে করেন, শীতকালে এই চাহিদা আরও বাড়তে পারে।
বিশ্লেষক ও অর্থনীতিবিদদের মতামত
বিশ্ববাজারে স্বর্ণের দাম বেড়ে যাওয়ার একাধিক কারণ রয়েছে। মার্কিন সরকারের অচলাবস্থা, ফেড কর্মকর্তাদের বিভ্রান্তিকর মন্তব্য এবং মার্কিন-চীনের বাণিজ্য উত্তেজনা আন্তর্জাতিক বাজারে স্বর্ণের মূল্য বাড়িয়ে দিয়েছে।
অ্যাক্টিভট্রেডস বিশ্লেষক রিকার্ডো ইভাঞ্জেলিস্টা বলেন, “মাঝারি থেকে দীর্ঘমেয়াদে স্বর্ণের দাম ৫ হাজার ডলারের স্তরে পৌঁছানো অসম্ভব নয়। আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা এই প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করছে।”
বিশ্ববাজারের সঙ্গে মিল রেখে বাংলাদেশেও স্বর্ণের দাম বৃদ্ধির প্রবণতা অব্যাহত থাকতে পারে। আন্তর্জাতিক ও দেশীয় বাজারের মধ্যে সামঞ্জস্য এবং টাকার মানের ওঠানামা স্বর্ণের দামকে প্রভাবিত করবে।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, স্বর্ণের দাম কমার সম্ভাবনা খুবই কম, বরং আগামী সময়ের চাহিদা বৃদ্ধি ও বিশ্ববাজারের অস্থিতিশীলতা এটিকে আরও উর্ধ্বমুখী করবে।
হঠাৎ কেন স্বর্ণের দাম বেড়ে যাচ্ছে তা বোঝার জন্য আন্তর্জাতিক অর্থনীতি, রাজনৈতিক অস্থিরতা, কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর ক্রয় এবং দেশীয় বাজারের চাহিদা-সরবরাহ পরিস্থিতি সব মিলিয়ে দেখতে হবে। স্বর্ণ দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে এখনও বিনিয়োগকারীদের কাছে অপরিহার্য।
বিশ্লেষকদের মতে, এই উর্ধ্বগতি শীঘ্রই থেমে যাওয়ার সম্ভাবনা কম। ফলে বিনিয়োগকারীদের সতর্ক এবং তথ্যভিত্তিক সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রয়োজন।
এম আর এম – ১৭৯৮,Signalbd.com