
দেশের বাজারে আবারও বেড়েছে ভোজ্যতেলের দাম। আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধি ও ডলারের দর বৃদ্ধির প্রভাব পড়ে স্থানীয় বাজারে। নতুন দামে প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেল বিক্রি হবে ১৯৫ টাকায়, যা আগে ছিল ১৮৯ টাকা। খোলা সয়াবিন তেলের দাম বেড়ে হয়েছে ১৭৭ টাকা। পাম তেলের দাম বেড়েছে আরও বেশি — প্রতি লিটার ১৩ টাকা বাড়িয়ে নির্ধারণ করা হয়েছে ১৬৩ টাকা।
ভোজ্যতেলের নতুন দাম ঘোষণা
সোমবার (১৩ অক্টোবর) এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিওআরবিএমএ) দাম বৃদ্ধির এ সিদ্ধান্ত জানায়। তারা জানায়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনার পর আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে নতুন দাম নির্ধারণ করা হয়েছে।
নতুন দামের তালিকা অনুযায়ী:
- বোতলজাত সয়াবিন তেল: লিটারে ৬ টাকা বৃদ্ধি, নতুন দাম ১৯৫ টাকা
- খোলা সয়াবিন তেল: লিটারে ৮ টাকা বৃদ্ধি, নতুন দাম ১৭৭ টাকা
- পাম তেল: লিটারে ১৩ টাকা বৃদ্ধি, নতুন দাম ১৬৩ টাকা
- পাঁচ লিটারের বোতলজাত সয়াবিন তেল: প্রতি বোতল ২৩ টাকা বৃদ্ধি, নতুন দাম ৯৪৫ টাকা
এই নতুন দাম ১৪ অক্টোবর থেকে সারাদেশে কার্যকর হবে বলে জানানো হয়েছে।
আগের দাম ও পরিবর্তনের ইতিহাস
চলতি বছরের এপ্রিলেও তেলের দাম সমন্বয় করা হয়েছিল। তখন বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম লিটারে ১৪ টাকা বাড়িয়ে ১৮৯ টাকা নির্ধারণ করা হয় এবং খোলা সয়াবিন তেল ১২ টাকা বেড়ে দাঁড়ায় ১৬৯ টাকায়।
এরপর আগস্টে খোলা পাম তেলের দাম ১৯ টাকা কমিয়ে ১৫০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছিল। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে নতুন করে তেলের দাম বাড়ায় এখন আবারও সেই হার বৃদ্ধি করতে হলো বলে জানায় রিফাইনারি মালিকদের সংগঠন।
২০২৪ সালের ডিসেম্বরে সর্বশেষ বোতলজাত তেলের দাম বাড়ানো হয়েছিল লিটারে ৮ টাকা। সেই সময় প্রতি লিটার সয়াবিন তেল ছিল ১৭৫ টাকা এবং খোলা তেল ১৫৭ টাকা।
আন্তর্জাতিক বাজারের প্রভাব
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার কাঁচামাল সরবরাহ কমে যাওয়ায় বিশ্ববাজারে পাম তেলের দাম বেড়েছে প্রায় ৭ শতাংশ। একই সঙ্গে ডলারের বিনিময় হার বেড়ে যাওয়ায় আমদানি খরচও বৃদ্ধি পেয়েছে।
বাংলাদেশের ভোজ্যতেল বাজার পুরোপুরি আমদানি নির্ভর। ফলে আন্তর্জাতিক দামের ওঠানামা সরাসরি প্রভাব ফেলে দেশীয় বাজারে।
বাংলাদেশে বছরে প্রায় ২০ লাখ টন ভোজ্যতেল ব্যবহৃত হয়, যার মধ্যে ৯০ শতাংশের বেশি আমদানি করা হয় মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও আর্জেন্টিনা থেকে।
সাধারণ মানুষের ওপর প্রভাব
দাম বৃদ্ধির এ সিদ্ধান্তে ভোক্তাদের ওপর বাড়তি চাপ পড়বে বলে আশঙ্কা করছেন বাজার বিশ্লেষকরা। রাজধানী ঢাকার খুচরা বাজারে এখন থেকেই অনেক দোকানদার নতুন দামে বিক্রি শুরু করেছেন।
গৃহিণী ও সাধারণ ক্রেতাদের অনেকেই বলছেন, বাজারে প্রতিদিনই কোনো না কোনো নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে। এবার তেলের দাম বাড়ায় গৃহস্থালির মাসিক বাজেট আরও চাপে পড়বে।
একজন ক্রেতা বলেন, “প্রতিদিন তেল ছাড়া রান্না হয় না। আগে এক লিটার তেলে পাঁচ দিন চলত, এখন খরচ বেড়ে যাচ্ছে। আমাদের পক্ষে এই দাম টেকানো কঠিন।”
ব্যবসায়ীদের বক্তব্য
বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যাসোসিয়েশনের এক কর্মকর্তা বলেন, “আমরা নিজেরা দাম বাড়াতে চাইনি। আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধি, ডলার সংকট এবং পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধি—সব মিলিয়ে এই সমন্বয় করা বাধ্যতামূলক হয়েছে।”
তিনি আরও বলেন, “বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নিয়ে দাম নির্ধারণ করা হয়েছে, যাতে আমদানিকারক ও বিক্রেতারা ক্ষতির মুখে না পড়ে। একই সঙ্গে আমরা বাজারে পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিত রাখব।”
সরকার কী বলছে?
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, বিশ্ববাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে দাম সমন্বয় করা হয়েছে। তবে বাজারে কৃত্রিম সংকট বা অতিরিক্ত মূল্য আদায় করলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে তিনি হুঁশিয়ারি দেন।
সরকার বাজার মনিটরিং জোরদার করছে বলে জানা গেছে, যাতে নতুন দাম কার্যকর হওয়ার আগে অতিরিক্ত মজুত বা কৃত্রিম সংকট তৈরি না হয়।
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
অর্থনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, যদি আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম স্থিতিশীল থাকে, তাহলে আগামী কয়েক মাসে আবারও দাম কমার সুযোগ থাকতে পারে। তবে ডলারের মূল্য ও পরিবহন ব্যয় যদি আরও বাড়ে, তাহলে বিপরীত পরিস্থিতিও হতে পারে।
দেশীয় উৎপাদন বাড়াতে ও পরিশোধন শিল্পে বিনিয়োগ বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা, যাতে বৈদেশিক নির্ভরতা কিছুটা হলেও কমে আসে।
বিশ্ববাজারের অস্থিরতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশের ভোজ্যতেল বাজারেও বারবার পরিবর্তন আসছে। এই মুহূর্তে ক্রেতাদের জন্য বাড়তি চাপ তৈরি হলেও দীর্ঘমেয়াদে স্থিতিশীল সরবরাহ বজায় থাকলে বাজারে ভারসাম্য ফিরতে পারে বলে আশা করা হচ্ছে।
এম আর এম – ১৭৫২,Signalbd.com