
চীনা পণ্যে নতুন শুল্ক: ট্রাম্পের ঘোষণায় বৈশ্বিক অস্থিরতা
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আবারও বিশ্ব অর্থনীতিতে বড় ধরনের আলোচনার জন্ম দিয়েছেন। তিনি ঘোষণা দিয়েছেন, আগামী মাস থেকে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করা চীনা পণ্যের ওপর বর্তমান ৩০ শতাংশ শুল্কের পাশাপাশি আরও ১০০ শতাংশ অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করা হবে। ফলে মোট শুল্কের পরিমাণ দাঁড়াবে ১৩০ শতাংশে।
শুক্রবার (১০ অক্টোবর ২০২৫) নিজস্ব সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম Truth Social-এ দেওয়া এক পোস্টে ট্রাম্প বলেন, “আমেরিকার বাজারকে চীনের সস্তা পণ্যে ভরিয়ে দেওয়া যাবে না। নিজেদের শিল্পকে রক্ষা করতে এই পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি হয়ে পড়েছে।”
এর পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ সফটওয়্যার ও প্রযুক্তি রপ্তানির ওপরও নতুন নিয়ন্ত্রণ আরোপের ঘোষণা দেন তিনি। ট্রাম্পের দাবি, চীন শুধু আমেরিকান শিল্পের ক্ষতি করছে না, বরং বৈশ্বিক শক্তি ব্যবস্থাকেও হুমকির মুখে ফেলছে।
চীনের বিরল জ্বালানি রপ্তানি নীতি নিয়ে ট্রাম্পের অভিযোগ
ট্রাম্পের শুল্ক ঘোষণার পেছনে বড় কারণ হিসেবে উঠে এসেছে চীনের বিরল মাটির খনিজ (Rare Earth Elements) রপ্তানিতে সীমাবদ্ধতা আরোপ। এই খনিজগুলো আধুনিক প্রযুক্তি, যেমন মোবাইল ফোন, বৈদ্যুতিক গাড়ি, সোলার প্যানেল, সামরিক সরঞ্জাম—এসব তৈরিতে অপরিহার্য।
ট্রাম্প বলেন, “চীন তাদের বিরল খনিজের সরবরাহ সীমিত করে বিশ্বের দেশগুলোকে জিম্মি করার চেষ্টা করছে। এটি স্পষ্টতই শত্রুতাপূর্ণ আচরণ।”
এমনকি তিনি সতর্ক করে দেন, যদি পরিস্থিতি না বদলায়, তবে তিনি চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে নির্ধারিত বৈঠক থেকেও সরে দাঁড়াতে পারেন। যদিও পরে জানান, বৈঠক এখনও বাতিল করা হয়নি।
মার্কিন শেয়ারবাজারে বড় ধস
ট্রাম্পের ঘোষণা প্রকাশের পরপরই মার্কিন শেয়ারবাজারে বড় ধরনের পতন দেখা যায়। প্রধান সূচক ডাও জোন্স ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যাভারেজ ২.৭% হ্রাস পেয়ে বন্ধ হয়। বিশ্লেষকদের মতে, এপ্রিল ২০২৫-এর পর এটিই সবচেয়ে বড় দৈনিক পতন।
বিশ্বজুড়ে বিনিয়োগকারীরা আশঙ্কা করছেন, নতুন শুল্ক ও বাণিজ্য সীমাবদ্ধতা শুধু চীন নয়, গোটা বৈশ্বিক অর্থনীতিকে নতুন অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্র-চীন বাণিজ্য যুদ্ধের ইতিহাস
ট্রাম্পের এই পদক্ষেপ হঠাৎ করে আসেনি। বরং এটি ২০১৮ সালে শুরু হওয়া যুক্তরাষ্ট্র-চীন বাণিজ্য যুদ্ধের ধারাবাহিকতা। সে সময় প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পই প্রথম চীনা পণ্যের ওপর অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করেন।
- ২০১৮ সালে ৫০ বিলিয়ন ডলারের চীনা পণ্যে শুল্ক আরোপ করা হয়।
- পরে ধাপে ধাপে এ শুল্কের পরিমাণ বাড়তে থাকে এবং ২০২০ সালের মধ্যে প্রায় ৩৭০ বিলিয়ন ডলারের পণ্য এর আওতায় আসে।
- বাইডেন প্রশাসন ক্ষমতায় এসে কিছুটা নরম নীতি নিলেও শুল্ক পুরোপুরি তুলে নেয়নি।
- এবার দ্বিতীয়বারের মতো প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর ট্রাম্প আবারও আগের অবস্থানে ফিরে গেলেন।
সম্ভাব্য প্রভাব:
১. ভোক্তা পর্যায়ে প্রভাব
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এত বেশি শুল্ক আরোপের ফলে আমেরিকান ভোক্তাদের জন্য চীনা পণ্যের দাম কয়েকগুণ বেড়ে যাবে। বিশেষ করে ইলেকট্রনিক্স, পোশাক, গৃহস্থালি সামগ্রী—এসব খাতে বড় ধাক্কা আসতে পারে।
২. আমেরিকার শিল্পে প্রভাব
ট্রাম্পের মতে, বাড়তি শুল্কের কারণে স্থানীয় শিল্প ও উৎপাদকরা সুরক্ষা পাবে। তবে অনেকে আশঙ্কা করছেন, কাঁচামালের দাম বাড়ায় আমেরিকান কোম্পানির উৎপাদন ব্যয়ও বেড়ে যাবে।
৩. চীনের প্রতিক্রিয়া
চীন অতীতে যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কনীতির প্রতিক্রিয়ায় পাল্টা শুল্ক আরোপ করেছে। এবারও তারা কৃষিপণ্য, প্রযুক্তি ও বিমান শিল্পে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে পারে।
৪. বৈশ্বিক অর্থনীতি
বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (WTO) দীর্ঘদিন ধরেই এই দুই অর্থনৈতিক পরাশক্তির মধ্যে সমঝোতার আহ্বান জানাচ্ছে। কিন্তু আবারও নতুন করে উত্তেজনা দেখা দিলে বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম ও জ্বালানির খরচ বাড়তে পারে।
বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণ
অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, ট্রাম্পের ঘোষণাটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতও হতে পারে। ২০২৫ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পর পুনরায় ক্ষমতায় এসে তিনি তার সমর্থক শ্রেণির কাছে “আমেরিকা ফার্স্ট” বার্তাটি আরও জোরালোভাবে তুলে ধরতে চাইছেন।
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিশ্লেষক জন হেনরি বলেন,
“ট্রাম্প চাইছেন ভোটারদের বোঝাতে, তিনি আমেরিকার স্বার্থেই কাজ করছেন। কিন্তু বাস্তবে এই শুল্ক নীতি ভোক্তাদের ক্ষতিগ্রস্ত করবে এবং বৈশ্বিক অর্থনীতিকে অস্থিতিশীল করবে।”
বিশ্বজুড়ে প্রতিক্রিয়া
- ইউরোপীয় ইউনিয়ন (EU) জানিয়েছে, এই বাণিজ্য যুদ্ধ বিশ্ব অর্থনীতিকে ঝুঁকিতে ফেলবে।
- জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া উদ্বেগ প্রকাশ করেছে, কারণ তাদের শিল্পও চীনের কাঁচামাল ও আমেরিকার বাজারের ওপর নির্ভরশীল।
- আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (IMF) সতর্ক করেছে, এই শুল্ক বৃদ্ধি বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধিকে কমিয়ে দিতে পারে।
চীনের সম্ভাব্য অবস্থান
বেইজিং এখনও আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানায়নি। তবে চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক মুখপাত্র বলেছেন, “আমরা বিশ্বাস করি আলোচনার মাধ্যমে সমাধান সম্ভব। যুক্তরাষ্ট্র যদি একতরফা পদক্ষেপ নেয়, চীনও পাল্টা ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হবে।”
ট্রাম্পের নতুন শুল্ক নীতি যুক্তরাষ্ট্র-চীন সম্পর্ককে আরও জটিল করে তুলেছে। বিশ্বের দুই বৃহত্তম অর্থনীতির এই সংঘাত শুধু তাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং পুরো বিশ্ব অর্থনীতিকে প্রভাবিত করবে।
এখন দেখার বিষয়, নভেম্বর থেকে কার্যকর হওয়া এই শুল্ক আদৌ পরিস্থিতি সামলাতে সাহায্য করে নাকি নতুন করে বৈশ্বিক অস্থিরতার জন্ম দেয়।
MAH – 13259 I Signalbd.com