
বিদায়ী ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বিদেশি ঋণের সুদ ও আসল মিলিয়ে ৪০৯ কোটি ডলার পরিশোধ করেছে বাংলাদেশ। অর্থনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বড় বড় মেগা প্রকল্পের কিস্তি শুরুর কারণে আগামীতে ঋণ শোধের চাপ আরও বাড়বে।
বাংলাদেশের ইতিহাসে এবার প্রথমবারের মতো এক অর্থবছরে বিদেশি ঋণ শোধের পরিমাণ ৪০০ কোটি ডলারের সীমা ছাড়িয়েছে। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সর্বশেষ প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে সুদ ও আসল মিলিয়ে ৪০৯ কোটি ডলার পরিশোধ করেছে বাংলাদেশ। এর ফলে দেশের বৈদেশিক ঋণ শোধের ক্ষেত্রে নতুন রেকর্ড তৈরি হয়েছে। অর্থনীতিবিদদের মতে, মেগা প্রকল্পগুলোর ঋণের কিস্তি পরিশোধ শুরু হওয়ায় এই চাপ আরও বাড়বে।
বিদেশি ঋণ শোধে রেকর্ড পরিমাণ ব্যয়
ইআরডির তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের জুলাই থেকে ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত মোট ৪০৮ কোটি ৬৯ লাখ ডলার বিদেশি ঋণ শোধ করা হয়েছে। এর মধ্যে ২৫৯ কোটি ডলার ছিল আসল ঋণ এবং ১৪৯ কোটি ডলার ছিল সুদের জন্য। মাসিক গড়ে ৩৪ কোটি ডলারের বেশি ঋণ পরিশোধ করতে হয়েছে সরকারকে। গত অর্থবছরে (২০২৩-২৪) বিদেশি ঋণ শোধের পরিমাণ ছিল ৩৩৭ কোটি ডলার।
বিদেশি ঋণের প্রতিশ্রুতি ও ছাড় কমেছে
বিদেশি ঋণ শোধের পরিমাণ বেড়ে গেলেও একই সময়ে নতুন ঋণ প্রতিশ্রুতি এবং ছাড় কমেছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বিদেশি ঋণ ছাড় হয়েছে ৮৫৭ কোটি ডলার এবং প্রতিশ্রুত ঋণের পরিমাণ ছিল ৮৩২ কোটি ডলার। বিশেষজ্ঞদের মতে, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং ঋণদাতা দেশগুলোর সতর্ক অবস্থান এর কারণ হতে পারে।
কোন সংস্থা দিয়েছে সবচেয়ে বেশি ঋণ
এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) গত অর্থবছরে ঋণ ছাড়ের ক্ষেত্রে শীর্ষে ছিল। তারা ২৫২ কোটি ডলার ঋণ দিয়েছে। এর পরের অবস্থানে রয়েছে বিশ্বব্যাংক এবং জাপান। তবে ভারত, চীন এবং রাশিয়া থেকে নতুন কোনো ঋণের প্রতিশ্রুতি পাওয়া যায়নি।
এক দশকে ঋণ শোধের চাপ চার গুণ
২০১২-১৩ অর্থবছরে বিদেশি ঋণ শোধের পরিমাণ ছিল মাত্র ১১০ কোটি ডলার। ২০২১-২২ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ২০১ কোটি ডলারে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে তা হয় প্রায় ৩০০ কোটি ডলার। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে সেই সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৪০৯ কোটি ডলার। অর্থাৎ গত এক দশকে বিদেশি ঋণ শোধের চাপ প্রায় চার গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
মেগা প্রকল্পের কারণে বাড়ছে দায়
অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল, মেট্রোরেল এবং শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনালের মতো বড় প্রকল্পগুলোর গ্রেস পিরিয়ড শেষ হয়েছে। ফলে এখন থেকে সুদ ও আসল শোধ শুরু হওয়ায় চাপ বেড়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে জাপানি ঋণের কিস্তি আগামী বছর থেকে নিয়মিতভাবে বাড়বে।
অর্থনীতিতে কী প্রভাব পড়বে
বিশ্লেষকদের মতে, বৈদেশিক ঋণ শোধে উচ্চ ব্যয় সরকারের উন্নয়ন বাজেটে চাপ তৈরি করছে। ডলার সংকট ও রিজার্ভের ওপরও এর প্রভাব পড়ছে। যদি রপ্তানি আয় এবং রেমিট্যান্স প্রবাহ না বাড়ে, তাহলে বৈদেশিক ঋণের বোঝা আরও ভারী হতে পারে। তবে সঠিক পরিকল্পনায় ঋণ ব্যবস্থাপনা করলে এবং বিনিয়োগ থেকে আয় বাড়ানো গেলে এ চাপ সামাল দেওয়া সম্ভব।
সারসংক্ষেপ
বিদেশি ঋণ শোধে বাংলাদেশের এ নতুন রেকর্ড দেশের ঋণ ব্যবস্থাপনার গুরুত্ব বাড়িয়ে দিয়েছে। অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, এখন থেকে সরকারের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে ঋণের টেকসই ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা। ভবিষ্যতে বৈদেশিক ঋণ শোধের চাপ কি আরও বাড়বে, নাকি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এ চাপ সামাল দিতে পারবে—সেটিই এখন সবার কাছে বড় প্রশ্ন।
এম আর এম – ০৫৭৭, Signalbd.com