
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা দিয়েছেন, আগামী ১ আগস্ট থেকে বাংলাদেশসহ মোট ১৪টি দেশের আমদানি পণ্যে নতুন করে শুল্ক আরোপ করা হবে। বাংলাদেশি পণ্যে নির্ধারিত নতুন শুল্কের হার দাঁড়িয়েছে ৩৫ শতাংশ। একই সাথে ট্রাম্প এই বিষয়ে বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে একটি চিঠি পাঠিয়েছেন, যেখানে বিস্তারিত বাণিজ্য নীতির ব্যাখ্যা ও ভবিষ্যতের সম্ভাব্য ব্যবস্থা সম্পর্কে তথ্য প্রদান করা হয়েছে।
ট্রাম্পের শুল্ক আরোপের পটভূমি ও বিস্তারিত
গত এপ্রিলে ট্রাম্প প্রশাসন বাংলাদেশি পণ্যে ৩৭ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছিলো, যা ৯ এপ্রিল থেকে কার্যকর হয়। বিশ্ব অর্থনীতির অস্থিতিশীলতার কারণে ৩ মাসের জন্য ওই শুল্ক স্থগিত করা হয়েছিল। কিন্তু এই স্থগিতাদেশ শেষ হওয়ার আগেই নতুন সিদ্ধান্তে শুল্ক হার কিছুটা কমিয়ে ৩৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হলো।
ট্রাম্পের এ সিদ্ধান্তের মাধ্যমে শুধু বাংলাদেশ নয়, দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানসহ ১৪টি দেশের আমদানি পণ্যের ওপর নতুন করে শুল্ক বৃদ্ধি পেয়েছে। দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানের পণ্যে ২৫ শতাংশ, মিয়ানমার ও লাওসের পণ্যে ৪০ শতাংশ, দক্ষিণ আফ্রিকা ৩০ শতাংশ, মালয়েশিয়া ২৫ শতাংশ, তিউনিসিয়া ২৫ শতাংশ, ইন্দোনেশিয়া ৩২ শতাংশ, বসনিয়া ৩০ শতাংশ, সার্বিয়া ৩৫ শতাংশ, কম্বোডিয়া ও থাইল্যান্ড ৩৬ শতাংশ এবং কাজাখস্তান ২৫ শতাংশ শুল্ক ধার্য করা হয়েছে।
ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে ট্রাম্পের চিঠির মূল বক্তব্য
ট্রাম্পের পাঠানো চিঠিতে বলা হয়েছে, ২০২৫ সালের ১ আগস্ট থেকে যুক্তরাষ্ট্রে আসা সব বাংলাদেশি পণ্যের ওপর ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হবে। এই শুল্ক মূলত বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বাণিজ্য ঘাটতির সমস্যার সমাধান হিসেবে নেওয়া হয়েছে। ট্রাম্প উল্লেখ করেছেন, “৩৫ শতাংশ শুল্ক আপনার দেশের সাথে আমাদের বাণিজ্য ঘাটতির সমস্যার সমাধানে যা প্রয়োজন তার চেয়ে কম।”
চিঠিতে আরও বলা হয়েছে, বাংলাদেশি কোম্পানিগুলো যদি যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে পণ্য তৈরি বা উৎপাদন শুরু করে, তাহলে কোনো শুল্ক আরোপ করা হবে না। অর্থাৎ আমদানি থেকে স্থানীয় উৎপাদনে উৎসাহিত করা হচ্ছে।
ট্রাম্প সতর্ক করে বলেছেন, বাংলাদেশ যদি পাল্টা কোনো শুল্ক আরোপ করে, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র তার বিরুদ্ধে আরও শুল্ক বাড়াতে পারে। তিনি বলেছেন, “এই শুল্কগুলো বহু বছরের বাণিজ্য ঘাটতি ও নীতিগত অসঙ্গতির কারণে প্রয়োজনীয়।”
শুল্ক বৃদ্ধির কারণ ও প্রভাব
যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক নীতি অনুযায়ী, দীর্ঘমেয়াদী বাণিজ্য ঘাটতি দেশটির জন্য অর্থনৈতিক ও জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি হিসেবে দেখা হয়। বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশের সঙ্গে যে বাণিজ্য ঘাটতি রয়েছে, সেটি কমানোর উদ্দেশ্যে এসব শুল্ক আরোপ করা হয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই শুল্কগুলো বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্য খাতে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে পারে। বিশেষত তৈরি পোশাক ও অন্যান্য খাদ্যশস্য পণ্যের ক্ষেত্রে মার্কিন বাজারের গুরুত্ব অনেক বেশি। মার্কিন বাজারে শুল্ক বাড়ার ফলে বাংলাদেশি পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পেতে পারে, যা আমেরিকান ক্রেতাদের জন্য পণ্যকে তুলনামূলকভাবে দামি করে তুলবে।
বাংলাদেশের প্রস্তুতি ও সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া
সরকার ও ব্যবসায়ী নেতারা ইতিমধ্যেই এই শুল্কের প্রভাব মোকাবিলায় পদক্ষেপ নেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছেন। রপ্তানিমুখী শিল্পগুলোকে আরও প্রতিযোগিতামূলক করার জন্য নতুন নীতি এবং প্রযুক্তিগত সহায়তা বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তা জোরদার হয়েছে। পাশাপাশি মার্কিন বাজারে প্রবেশাধিকার বজায় রাখতে ব্যবসায়িক কৌশল পরিবর্তনের ওপর গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে।
ড. মুহাম্মদ ইউনূসসহ সংশ্লিষ্ট বাণিজ্য বিশেষজ্ঞরা যুক্তরাষ্ট্রের সাথে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা জোরদার করতে এবং শুল্ক কমানোর জন্য কূটনৈতিক প্রচেষ্টা শুরু করেছেন।
বিশ্বব্যাপী শুল্কবৃদ্ধির প্রবণতা
গত কয়েক বছরে বিশ্ব বাণিজ্যে শুল্ক বৃদ্ধি ও প্রোটেকশনের প্রবণতা বেড়েছে। বিশেষ করে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের আমলে বাণিজ্য যুদ্ধ ও শুল্ক আরোপ বিষয়টি ব্যাপক আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে বাণিজ্য যুদ্ধ, ইউরোপীয় ইউনিয়নের শুল্ক নীতি, এবং অন্যান্য দেশে রক্ষক নীতির পুনঃপ্রবর্তন বিশ্ব অর্থনীতিতে অস্থিরতার সৃষ্টি করেছে।
এ অবস্থায়, বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোকে নিজেদের রপ্তানি পণ্য বৈচিত্রকরণ ও আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বৃদ্ধির ওপর কাজ করতে হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ বাংলাদেশের জন্য বড় ধরনের বাণিজ্য চ্যালেঞ্জ নিয়ে এসেছে। তবে এটি বাংলাদেশের জন্য এক ধরনের সংকেতও যে, দেশের রপ্তানি খাতের নতুন দিকনির্দেশনা, উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি এবং বৈশ্বিক বাজারে প্রতিযোগিতার সক্ষমতা বাড়াতে হবে।
বাণিজ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশের জন্য এখনই সময় বাণিজ্য নীতি আধুনিকায়ন ও বৈশ্বিক প্রবণতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার। অন্যদিকে, সরকার ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে সমন্বয় বাড়িয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মতো বড় বাজারে প্রবেশাধিকার রক্ষা ও সম্প্রসারণের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া অপরিহার্য।