বানিজ্য

ইসরায়েলি বন্ডে আর বিনিয়োগ নয়—ঘোষণা দিলেন জোহরান মামদানি

নিউইয়র্ক সিটির মেয়র পদে ডেমোক্র্যাটিক প্রার্থী জোহরান মামদানি সম্প্রতি ঘোষণা করেছেন যে, তিনি শহরের পেনশন তহবিলকে ইসরায়েলি বন্ডে বিনিয়োগ না করার পক্ষে। মামদানি উল্লেখ করেছেন, আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের সঙ্গে জড়িত কোনো অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে শহরের তহবিল যুক্ত থাকা উচিত নয়।

নিউইয়র্কে সিবিএস টেলিভিশনের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে মামদানি বলেন, “আমরা আমাদের মূল্যবোধ এবং আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি দায়বদ্ধ। পেনশন তহবিল এমন কোনো কর্মকাণ্ডে বিনিয়োগ করা উচিত নয় যা আইন লঙ্ঘন করে।”

ইসরায়েলি বন্ডে বিনিয়োগ: ইতিহাস ও বর্তমান পরিস্থিতি

নিউইয়র্ক সিটির পেনশন তহবিল দীর্ঘদিন ধরে ইসরায়েলি কোম্পানি ও রিয়েল এস্টেটে বিনিয়োগ করে আসছে। গত প্রায় ৫০ বছর ধরে এই তহবিল ইসরায়েলি বন্ডে অংশগ্রহণ করেছে।

বর্তমানে শহরের পাঁচটি প্রধান পেনশন তহবিল রয়েছে:

  1. নিউইয়র্ক এমপ্লয়িজ রিটায়ারমেন্ট সিস্টেম
  2. নিউইয়র্ক সিটি ফায়ার পেনশন ফান্ড
  3. নিউইয়র্ক পুলিশ পেনশন ফান্ড
  4. নিউইয়র্ক সিটি টিচার্স রিটায়ারমেন্ট সিস্টেম
  5. নিউইয়র্ক সিটি বোর্ড অব এডুকেশন রিটায়ারমেন্ট সিস্টেম

এই পেনশন তহবিলগুলোর মোট সম্পদের পরিমাণ প্রায় ২৮৯ বিলিয়ন ডলার। এই তহবিলগুলোর তত্ত্বাবধান করেন সিটির কম্পট্রোলার।

২০২৩ সালে বর্তমান কম্পট্রোলার ব্র্যাড ল্যান্ডার নীতি পরিবর্তন করে, নতুন কোনো ইসরায়েলি বন্ড কেনা বন্ধ করেন। তার আগে তহবিলের প্রায় ৩০০ মিলিয়ন ডলার ইসরায়েলি বিনিয়োগে ছিল। ল্যান্ডারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, বিদেশি সরকারের ঋণে বিনিয়োগ সীমিত করা হচ্ছে এবং বিশেষ কোনো দেশের প্রতি অতিরিক্ত সুবিধা দেওয়া হচ্ছে না।

জোহরান মামদানি কেন এ অবস্থান নিলেন

ম্যাচলিক ভাবে জোহরান মামদানি মনে করেন, শহরের পেনশন তহবিলের বিনিয়োগ কেবল আর্থিক নয়, তা মূল্যবোধেরও প্রকাশ। তিনি বলেছেন, “আমরা প্রথমে দেখতে চাই, শহরের তহবিল কোথায় সরাসরি জড়িত। যেসব ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন হচ্ছে, সেই সব ক্ষেত্রে আমাদের তহবিল জড়িত থাকা উচিত নয়।”

মামদানি আরও যোগ করেছেন, বর্তমান কম্পট্রোলার ব্র্যাড ল্যান্ডারের ইসরায়েলি বন্ড নিয়ে নেওয়া পদক্ষেপই সঠিক পথ। তিনি বলেন, “কম্পট্রোলারের অবস্থানই শহরের নীতি এবং আন্তর্জাতিক আইনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।”

বিতর্ক ও সমালোচনা

ল্যান্ডারের ২০২৩ সালের সিদ্ধান্ত ঘোষণার পর বিতর্ক শুরু হয়। সমালোচকরা অভিযোগ করেন, তিনি ফিলিস্তিনপন্থী শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বাধীন ‘বয়কট, ডাইভেস্টমেন্ট অ্যান্ড স্যাংশনস (BDS)’ আন্দোলনের প্রভাবকে মান্য করেছেন। তবে ল্যান্ডার তার সিদ্ধান্তকে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত নয় বলে দাবি করেন।

মামদানি তাঁর প্রচারণার সময়ে বারবার বলেছেন, প্রশাসন যদি আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে, তবে তা পুনর্বহাল করা জরুরি। সম্প্রতি তিনি আরও স্পষ্টভাবে জানিয়েছেন যে, শহরের সম্পৃক্ততা কোথায় সবচেয়ে বেশি তা চিহ্নিত করা এবং সেই অনুযায়ী বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রয়োজন।

আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট

নিউইয়র্কের পেনশন তহবিল শুধুমাত্র শহরের নয়, যুক্তরাষ্ট্রের বৃহত্তম তহবিলগুলোর মধ্যে একটি। এ ধরনের বিনিয়োগ নীতি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নজর কাড়ে। ইসরায়েলি বন্ডে বিনিয়োগ নিয়ে বিশ্বব্যাপী বিতর্ক রয়েছে, কারণ বিভিন্ন দেশের মানবাধিকার সংস্থা ও আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক ইসরায়েলের কর্মকাণ্ডকে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন হিসেবে দেখেছে।

মামদানি বলেছেন, আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের সঙ্গে যুক্ত কোনো বিনিয়োগে শহরের তহবিল জড়িত হওয়া উচিত নয়। তিনি আরও বলেন, “আমরা যদি এমন কোনো বিনিয়োগ করি যা আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে, সেটি শহরের মূল্যবোধের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হবে না।”

ব্রুকলিনে টাউন হল সভা ও বার্নি স্যান্ডার্সের সঙ্গে সমর্থন

৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫ সালে ব্রুকলিনে এক টাউন হল সভায় জোহরান মামদানি অংশ নেন। সেখানে ভারমন্টের সিনেটর বার্নি স্যান্ডার্সও উপস্থিত ছিলেন। সভায় প্রায় ১,৭০০ মানুষ অংশগ্রহণ করেন।

এই সভার মূল উদ্দেশ্য ছিল বড় করপোরেট গোষ্ঠী ও ধনকুবেরদের আধিপত্যের বিরুদ্ধে জনগণকে সচেতন করা এবং অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতা সাধারণ মানুষের হাতে ফিরিয়ে আনা। মামদানি এই সভায় তাঁর অবস্থান আরও শক্ত করেন এবং ফিলিস্তিনপন্থী শিক্ষার্থীদের প্রতি সমর্থন প্রকাশ করেন।

মেয়র পদপ্রার্থী হিসেবে তাঁর লক্ষ্য

জোহরান মামদানি নিউইয়র্ক সিটির মেয়র নির্বাচনে যে মূল বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দিচ্ছেন, তা হলো:

  • পেনশন তহবিলের নীতি পুনঃমূল্যায়ন: আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন ও মানবাধিকার লঙ্ঘন সংক্রান্ত বিনিয়োগ এড়িয়ে চলা।
  • শহরের মূল্যবোধ রক্ষা: যেসব বিনিয়োগ শহরের নৈতিক ও আইনগত মানের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, সেগুলো থেকে দূরে থাকা।
  • সাধারণ মানুষের ক্ষমতায়ন: অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতা সাধারণ জনগণের হাতে ফেরানো।
  • শিক্ষা ও মানবাধিকার: ফিলিস্তিনপন্থী শিক্ষার্থীদের প্রতি সমর্থন এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে স্বাধীন মতপ্রকাশের অধিকার রক্ষা।

মামদানি এমন একটি সিটি গড়তে চান যেখানে অর্থনৈতিক নীতি ও বিনিয়োগ আন্তর্জাতিক আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং সাধারণ মানুষের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়।

পেনশন তহবিল ও ইসরায়েলি বিনিয়োগের পরিসংখ্যান

তহবিলের নামমোট সম্পদ (বিলিয়ন ডলার)ইসরায়েলি বিনিয়োগ (মিলিয়ন ডলার)
নিউইয়র্ক এমপ্লয়িজ রিটায়ারমেন্ট সিস্টেম80100
নিউইয়র্ক সিটি ফায়ার পেনশন ফান্ড3050
নিউইয়র্ক পুলিশ পেনশন ফান্ড4070
নিউইয়র্ক সিটি টিচার্স রিটায়ারমেন্ট সিস্টেম10080
নিউইয়র্ক সিটি বোর্ড অব এডুকেশন রিটায়ারমেন্ট সিস্টেম3915

মোট: ২৮৯ বিলিয়ন ডলার সম্পদ, যার মধ্যে ৩১৫ মিলিয়ন ডলার ইসরায়েলি বিনিয়োগে রয়েছে।

নিউইয়র্ক সিটির মেয়র পদপ্রার্থী জোহরান মামদানির এই সিদ্ধান্ত আন্তর্জাতিক আইন ও নৈতিক বিনিয়োগ নীতির দিকে জোর দিচ্ছে। শহরের পেনশন তহবিল শুধুমাত্র আর্থিক লাভের জন্য নয়, সামাজিক ও আন্তর্জাতিক দায়বদ্ধতার দিক থেকেও পরিচালিত হবে।

নির্বাচন প্রার্থীর এই অবস্থান সমালোচকদের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে, তবে সাধারণ মানুষ ও শিক্ষার্থী সম্প্রদায়ের মধ্যে এটি ইতিবাচক সাড়া ফেলেছে। নিউইয়র্কের ভবিষ্যৎ বিনিয়োগ নীতি ও মানবাধিকার সংক্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গির জন্য এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

MAH – 12841  Signalbd.com

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button