ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা যে কারণে ‘আন্তর্জাতিক’ থাকছে না

দীর্ঘ ২৯ বছর ধরে দেশের প্রধান বাণিজ্য মেলাগুলোর অন্যতম হিসেবে পরিচিত ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা (ডিআইটিএফ) এবার নতুন রূপে পথ চলা শুরু করতে যাচ্ছে। ১৯৯৫ সাল থেকে নিয়মিত আয়োজন করা এই মেলার নাম আগামী বছর থেকে বদলে যাবে। আর নামের সঙ্গে বদলাবে মেলার আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তিও। এখন থেকে এটি পরিচিত হবে ‘ঢাকা বাণিজ্য মেলা’ (ডিটিএফ) নামে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, বিদেশি প্রতিষ্ঠানের সরাসরি অংশগ্রহণ না হওয়া এবং পণ্যের মান নিয়ে ওঠা প্রশ্নের কারণে এই নাম পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
নাম পরিবর্তনের পেছনের কারণ
ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলার মূল লক্ষ্য ছিল বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর সরাসরি অংশগ্রহণের মাধ্যমে তাদের গুণগত মানসম্পন্ন পণ্য ও প্রযুক্তি প্রদর্শন করা। এর পাশাপাশি স্থানীয় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আন্তর্জাতিক ব্যবসায়িক সংযোগ স্থাপন করাও মেলার অন্যতম উদ্দেশ্য।
কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে, অনেক বিদেশি প্রতিষ্ঠান সরাসরি মেলায় অংশ না নিয়ে স্থানীয় এজেন্ট বা প্রতিনিধি দিয়ে স্টল পরিচালনা করছেন। ফলে পণ্যের গুণগত মান যাচাই করা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। অনেক সময় স্থানীয়ভাবে তৈরি পণ্যকেই বিদেশি ব্র্যান্ড হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে।
এটির ফলশ্রুতিতে ক্রেতারা বিভ্রান্ত হচ্ছেন এবং মেলার আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এই বাস্তবতার কারণে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং ইপিবি (এক্সপোর্ট প্রমোশন ব্যুরো) নাম পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নেন।
ইপিবির ভাইস চেয়ারম্যান মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, “মেলার নাম আন্তর্জাতিক হলেও প্রকৃত অর্থে এটি আন্তর্জাতিক মেলা নয়। তাই এই পরিবর্তন অপরিহার্য ছিল।”
বৈঠক এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ
গত সোমবার ইপিবির ১৪৮তম পরিচালনা পর্ষদের বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করা হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন, উপস্থিত ছিলেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব মাহবুবুর রহমান, ইপিবির ভাইস চেয়ারম্যান মো. আনোয়ার হোসেন এবং বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংগঠনের প্রতিনিধিরা।
নির্ধারিত বৈঠকে বোর্ডের কিছু সদস্য নাম পরিবর্তনের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে হলেও চেয়ারম্যান এবং বাণিজ্য উপদেষ্টা সিদ্ধান্তে অনড় ছিলেন। তারা মনে করেন, মেলার প্রকৃত আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তির সঙ্গে বর্তমান নাম মেলেনি।
নতুন ক্যালেন্ডার এবং পরিকল্পনা
সাধারণ নাম পরিবর্তনের পাশাপাশি আগামী দুই বছরের জন্য মেলার ক্যালেন্ডারও অনুমোদিত হয়েছে। ২০২৫-২৬ এবং ২০২৬-২৭ অর্থবছরের জন্য আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলার তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে, যাতে দেশি ব্যবসা সম্প্রসারণে তা কার্যকরভাবে অবদান রাখতে পারে।
বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন সভায় প্রতিটি মেলার কার্যকারিতা বিশ্লেষণ এবং ব্যবসায়িক সম্ভাবনা বৃদ্ধিতে গুরুত্বারোপ করেছেন। তিনি বলেন, “আমরা চাই প্রতিটি মেলা দেশের রপ্তানি শিল্প ও উদ্যোক্তাদের জন্য বাস্তবিক উপকার বয়ে আনুক।”
আন্তর্জাতিক বাজারে রপ্তানি সম্প্রসারণের নতুন উদ্যোগ
ডিআইটিএফ-র নতুন রূপে নাম পরিবর্তনের পাশাপাশি ইপিবি একটি নতুন আন্তর্জাতিক সোর্সিং ফেয়ার আয়োজনের উদ্যোগ নিয়েছে। আগামী নভেম্বর অনুষ্ঠিতব্য ‘সোর্সিং বাংলাদেশ ২০২৫’ মেলার মাধ্যমে দেশের রপ্তানিমুখী পণ্যের আন্তর্জাতিক পরিচিতি বাড়ানোর লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।
বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান বলেন, “এই ধরনের সোর্সিং মেলার মাধ্যমে দেশের উৎপাদকরা সরাসরি বৈশ্বিক বাজারে নিজেদের পণ্য প্রদর্শন করতে পারবে। এতে বিদেশি ক্রেতাদের সঙ্গে সরাসরি সংযোগ তৈরি হবে এবং দেশের রপ্তানি সক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে।”
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এই পদক্ষেপ রপ্তানি খাতের জন্য একটি যুগান্তকারী উদ্যোগ। কারণ এটি শুধুমাত্র স্থানীয় বাজার নয়, বরং আন্তর্জাতিক বাজারে দেশি পণ্যের বিশ্বাসযোগ্যতা ও মান বৃদ্ধি করবে।
মেলার আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তিতে প্রভাব
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ডিআইটিএফের আগে বিদেশি অংশগ্রহণকারীদের সংখ্যা প্রতিবার কমছে। ২০১৫ সালের পর বিদেশি কোম্পানির সরাসরি অংশগ্রহণ শূন্যের কোঠায় নেমেছে। এর ফলে মেলার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে উঠেছে।
স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জানাচ্ছেন, “অফশোর এজেন্টদের মাধ্যমে পণ্য প্রদর্শন হলে ক্রেতা প্রতারিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এতে মেলার বিশ্বাসযোগ্যতা কমে যায়।”
এই কারণেই নতুন নাম ও নতুন পরিকল্পনা, যেমন সোর্সিং বাংলাদেশ মেলা, আন্তর্জাতিক মানের ব্যবসায়িক সম্পর্ক উন্নয়নে সহায়ক হবে।
ভবিষ্যৎ দৃষ্টিকোণ
নাম পরিবর্তন শুধু একটি আনুষ্ঠানিক পদক্ষেপ নয়। এটি দেশের রপ্তানি খাত, উদ্যোক্তা এবং ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের জন্য নতুন দিকনির্দেশনা।
- বিদেশি প্রতিষ্ঠান সরাসরি অংশগ্রহণের সুযোগ বাড়ানো
- মান যাচাই প্রক্রিয়া শক্তিশালী করা
- আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের জন্য স্বচ্ছ ও নির্ভরযোগ্য বাণিজ্য পরিবেশ তৈরি করা
- দেশি পণ্যের বৈশ্বিক বাজারে পরিচিতি বৃদ্ধি করা
এই পদক্ষেপগুলো বাংলাদেশের বাণিজ্য ক্ষেত্রে একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে।
MAH – 12405 , Signalbd.com