ডিজিটালে বাংলা লেখার বিবর্তন: প্রযুক্তির অগ্রগতিতে এক যুগান্তকারী পরিবর্তন

কম্পিউটারে বাংলা লেখার প্রচলন শুরু হয়েছিল প্রায় ৪০ বছর আগে, ১৯৮৫ সালে সাইফুদ্দাহার শহীদের ম্যাকিন্টোশে বাংলা চিঠি লেখার মাধ্যমে। প্রযুক্তির অগ্রগতির সাথে বাংলা লেখার ব্যবস্থাও যুগে যুগে পরিবর্তিত হয়েছে। ২১ ফেব্রুয়ারির আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসকে সামনে রেখে, আমরা আজকের এই প্রতিবেদনে ডিজিটালে বাংলা লেখার ইতিহাস এবং এর বিবর্তন নিয়ে আলোচনা করব।
কম্পিউটারে বাংলা লেখার সূচনা
কম্পিউটার সাধারণত মানুষের ভাষা বোঝে না, এটি শুধুমাত্র বাইনারি কোডের মাধ্যমে তথ্য প্রক্রিয়া করে। কিন্তু বাংলা ভাষার জন্য কম্পিউটারে লেখার ব্যবস্থা শুরু হয়েছিল একাধিক সফটওয়্যার এবং কি-বোর্ড লে আউটের মাধ্যমে।
১৯৬৫ সালে মুনির চৌধুরী টাইপরাইটারের জন্য বাংলা লেখার প্রথম বিশেষ লে আউট তৈরি করেছিলেন। যদিও মুনিরের লে আউট কম্পিউটারে ব্যবহৃত হয়নি, তবে তার কাজ কম্পিউটারের বাংলা লেখার ক্ষেত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ছিল।
১৯৮৫ সালের ২৫ জানুয়ারি, প্রকৌশলী সাইফুদ্দাহার শহীদ প্রথম কম্পিউটারে বাংলা চিঠি লিখেছিলেন। তিনি ম্যাকিন্টোশ প্ল্যাটফর্মের জন্য তৈরি করেছিলেন “শহীদলিপি” সফটওয়্যার, যা বাংলা লেখার ক্ষেত্রে এক যুগান্তকারী আবিষ্কার ছিল।
বাংলা লে আউটের উদ্ভব
বাংলা লেখার সফটওয়্যারের মধ্যে অন্যতম প্রথম ছিল বিজয়। ১৯৮৮ সালে মোস্তাফা জব্বার ও গোলাম ফারুখ আহমেদ এর প্রতিষ্ঠানে তৈরি হয়েছিল বিজয় সফটওয়্যার। এই সফটওয়্যারটি দ্রুত জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল এবং তা পরবর্তী সময়ে উইন্ডোজের জন্যও উন্মুক্ত করা হয়।
১৯৯৩ সালে উইন্ডোজের জন্য বিজয়ের সংস্করণ প্রকাশিত হলে তা ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হতে থাকে। একই সময়ে আরও কিছু সফটওয়্যার যেমন, অনির্বাণ, প্রবর্তন, লেখনী, এবং প্রশিকা শব্দ বাজারে আসে, তবে সেগুলোর জনপ্রিয়তা ছিল সাময়িক।
অভ্র কি-বোর্ডের উত্থান
২০০৩ সালে মেহদী হাসান খান অভ্র কি-বোর্ড তৈরি করেন। এই সফটওয়্যারটি দ্রুত জনপ্রিয়তা লাভ করে কারণ এটি ইউনিকোড ফরম্যাটে বাংলা লেখার ব্যবস্থা করেছিল। এর ফলে, অভ্র বাংলা লেখার জন্য এক সর্বজনীন প্ল্যাটফর্মে পরিণত হয়।
অভ্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল তার ফোনেটিক টাইপিং সিস্টেম, যেখানে ইংরেজি অক্ষর টাইপ করলে তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাংলা ভাষায় পরিণত হয়ে যেত। এটি ব্যবহারকারীকে সহজভাবে বাংলা লেখার সুযোগ দেয়। সোশ্যাল মিডিয়া এবং ব্লগিংয়ের জন্য ইউনিকোড ব্যবহারের গুরুত্ব বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে সাথে অভ্র আরও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
অন্যান্য বাংলা লে আউট
বিজয়ের পাশাপাশি বেশ কিছু অন্যান্য লে আউটও জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। এর মধ্যে ছিল টাইপরাইটার থেকে সংগৃহীত মুনিয়ের লে আউট, জাপানি ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব অ্যাডভান্সড ইন্ডাস্ট্রিয়াল সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির মাধ্যমে তৈরি একুশে প্রজেক্টের ইউনিজয় লে আউট, এবং মাইক্রোসফট উইন্ডোজের ইনস্ক্রিপ্ট লে আউট।
২০০৪ সালে বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল বাংলা জাতীয় কি-বোর্ড লে আউট তৈরির উদ্যোগ নেয়, যা এখনও বাংলাদেশের প্রমিত লে আউট হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
স্মার্টফোনে বাংলা লেখার প্রযুক্তি
আজকের দিনে, অ্যানড্রয়েড এবং আইওএস ডিভাইসগুলোতে বাংলা লেখার জন্য আলাদা সফটওয়্যার ব্যবহারের প্রয়োজন নেই। বিল্ট-ইন কি-বোর্ডের মধ্যে ফোনেটিক টাইপিং সিস্টেম দেওয়া থাকে। এর মাধ্যমে ব্যবহারকারীরা সরাসরি বাংলা লিখতে পারেন, যা স্মার্টফোন ব্যবহারে বাংলা লেখার প্রসারে সহায়ক হয়েছে।
অ্যানড্রয়েড স্মার্টফোনে রিদমিক, মায়াবি, এবং ইনডিক প্রজেক্টের মাধ্যমে বাংলা লেখার সূচনা হয়েছিল, যা এখনো ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
বাংলা ফন্ট ডিজাইন
বাংলা লেখার জন্য ফন্ট ডিজাইনের ক্ষেত্রেও উন্নতি হয়েছে। ইউনিকোড এবং অ্যানসি ফরম্যাটে বাংলা ফন্ট ডিজাইনের জন্য বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। লিপিঘর, বঙ্গলিপি, ফন্টলিপি, বেঙ্গলফন্টস, এবং ফন্টবিডির মতো প্রতিষ্ঠানগুলি বাংলা ফন্ট ডিজাইনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
আজকাল, অনেক তরুণ ডিজাইনার বাংলা ফন্ট ডিজাইনকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করছেন, যা বাংলা ভাষার ডিজিটাল প্রকাশনার ক্ষেত্রে একটি নতুন দিগন্ত খুলেছে।
ডিজিটালে বাংলা লেখার ভবিষ্যত
ডিজিটালে বাংলা লেখার প্রযুক্তি এখনও দ্রুত উন্নতি লাভ করছে। একদিকে যেমন স্মার্টফোন এবং কম্পিউটারে বাংলা লেখার সফটওয়্যারগুলির উন্নতি হয়েছে, তেমনি বাংলা ভাষার ডিজিটাল প্রকাশনার ক্ষেত্রেও অনেক নতুন দিগন্ত খুলছে। একদিকে ইউনিকোডের সুবিধা, অন্যদিকে বিভিন্ন সফটওয়্যার এবং ফন্ট ডিজাইনের প্রগ্রেস—এইসব মিলে বাংলা ভাষার ডিজিটাল দুনিয়া আরও সাশ্রয়ী এবং ব্যবহারবান্ধব হয়ে উঠেছে।
কম্পিউটারের বাংলা লেখার ইতিহাস থেকে শুরু করে বর্তমান সময় পর্যন্ত, প্রযুক্তির অগ্রগতির মাধ্যমে বাংলা ভাষার ডিজিটাল লেখালেখি এক অনন্য অবস্থানে পৌঁছেছে। ভবিষ্যতে আরও নতুন নতুন উদ্ভাবন বাংলার ডিজিটাল ব্যবহারকে আরও উন্নত করবে, যা আমাদের মাতৃভাষা বাংলাকে সারা বিশ্বের মধ্যে আরও বিস্তার ঘটাবে।