
দেশের staple খাদ্য চালের দাম সাম্প্রতিক এক মাসে কেজিতে ৩ থেকে ৮ টাকা পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে, যা গত বছরের তুলনায় প্রায় ১৫ শতাংশেরও বেশি। এই দাম বৃদ্ধির পেছনে সরবরাহ সংকট, বাজার অস্থিরতা এবং কোরবানির ঈদের বিশেষ চাহিদাকে মূল কারণ হিসেবে ধরা হচ্ছে।
চালের বাজারে মূল্যবৃদ্ধির ছবি
রাজধানীর মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটে দেখা যায়, চালের আড়ৎগুলোতে নতুন চালের বস্তা সাজানো থাকলেও দাম নিয়ন্ত্রণে নেই। বিশেষ করে সরু চাল যেমন ‘নাজির’ ও ‘মিনিকেট’ প্রজাতির চালের কেজিতে গত এক মাসে প্রায় ৭ থেকে ৮ টাকা পর্যন্ত দাম বেড়েছে। অন্যদিকে মোটা চাল যেমন ‘আটাশ’ ও ‘গুটিস্বর্ণা’র দামও ৩ থেকে ৪ টাকা পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে।
একজন পাইকারি বিক্রেতা জানান, কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে চালের দাম বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি সাধারণ মাসেও দাম বেড়েছে বেশি। “চালের দাম হঠাৎ করেই ৮ থেকে ৯ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে, যা পূর্বের তুলনায় অনেক বেশি,” তিনি জানান।
বছরের ব্যবধানে দাম বৃদ্ধির প্রভাব
বাজার পর্যবেক্ষণে জানা গেছে, গত এক বছরে সরু চালের দাম প্রতি কেজিতে ১০ থেকে ১৪ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। মোটা চালের দামও প্রায় ৭ টাকা পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। এই দীর্ঘমেয়াদী মূল্যবৃদ্ধি সাধারণ মানুষের বিশেষ করে নিম্ন আয়ের মানুষদের জীবনযাত্রায় বড় ধরনের চাপ সৃষ্টি করেছে।
একজন ক্রেতা অভিযোগ করেন, “আগে যেই দামে চাল কিনতাম, এখন সেই দামের থেকে অনেক বেশি দাম দিয়ে চাল কিনতে হচ্ছে।”
সরবরাহ সংকট ও মিলারদের ভূমিকা
পাইকারি বিক্রেতারা বলছেন, বাজারে চাল সরবরাহ কমিয়েছেন মিলাররা, যার ফলে দাম বাড়ার প্রবণতা তীব্র হচ্ছে। চালের ভরা মৌসুমেও এই অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির নজির আগের বছরগুলোর তুলনায় অনেক বেশি।
খাদ্য উপদেষ্টার মন্তব্য
খাদ্য উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদার বাজার পরিস্থিতি নিয়ে সতর্ক, তিনি বলেন, “দাম বৃদ্ধি হয়েছে, তবে সামান্য মাত্রায়। আমরা বাজারে কঠোর নজরদারি করছি। চালের দাম যাতে বেশি না বাড়ে তা নিশ্চিত করার জন্য আগামী মাস থেকে ওএমএস (অপারেশনাল মনিটরিং সিস্টেম) চালু করা হবে এবং নিরাপদ খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি কার্যকর করা হবে।”
তিনি আরও জানান, “সরকার বোরো মৌসুমে চাল সংগ্রহ করেছে, যার কারণে সাময়িকভাবে বাজারে কিছু অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। তবে আমাদের লক্ষ্য দাম স্থিতিশীল রাখা।”
সরকারি মজুদ পরিস্থিতি
খাদ্যমন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, ২০২৫ সালের জুলাই মাসের শুরুতে সরকারি গুদামে চালের মজুদ ছিল প্রায় ১৫ লাখ ৪১ হাজার টন, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৪ লাখ ৮১ হাজার টন বেশি। এর অর্থ, মজুদ থাকা সত্ত্বেও বাজারে দাম বৃদ্ধি কেবল সরবরাহ সীমিত হওয়ার কারণে নয়, অন্য কিছু অর্থনৈতিক ও বাজারের প্রভাবেও হতে পারে।
কোরবানির ঈদ ও চালের চাহিদা
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোরবানির ঈদের সময় দেশের বাজারে চালের চাহিদা বেড়ে যায়, যা স্বাভাবিকভাবেই দাম বাড়ানোর অন্যতম কারণ। এছাড়া, বর্ষার মৌসুমে চাল পরিবহন ও সরবরাহ ব্যাহত হওয়াও দাম বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছে।
চালের দাম বৃদ্ধির প্রভাব ও সমাধান
চালের দাম বৃদ্ধির প্রভাব বাংলাদেশের গরিব ও মধ্যবিত্ত পরিবারের জন্য উদ্বেগজনক। খাদ্যের মূল উপাদানের দাম বাড়লে সারা পরিবারের জীবনযাত্রার ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। নিম্ন আয়ের মানুষেরা বিকল্প খাদ্য খোঁজার চেষ্টা করলেও চালের বিকল্প খুব কম। এই পরিস্থিতিতে সরকারের তরফ থেকে কার্যকর নীতিমালা প্রয়োজন।
বাজার স্থিতিশীলতার জন্য করণীয়
- সরকারি গুদামের চাল দ্রুত সরবরাহ: মজুদ থেকে বাজারে পর্যাপ্ত চাল সরবরাহ নিশ্চিত করা প্রয়োজন যাতে বাজারের চাহিদা পূরণ হয়।
- অপারেশন মনিটরিং সিস্টেম (ওএমএস) চালু: বাজারে কালোবাজারি বন্ধ করতে এবং সরবরাহ নিয়ন্ত্রণে রাখতে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
- নিরাপদ খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি: চালের উৎপাদন ও বিপণনে সঠিক নীতিমালা প্রণয়ন এবং প্রণোদনা দিতে হবে।
- মিলারদের নিয়ন্ত্রণ: অযথা সরবরাহ সীমিত করা বন্ধ করে বাজারে সুষ্ঠু প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করতে হবে।
- জনসচেতনতা বৃদ্ধি: চাল সংরক্ষণ ও সঠিক ব্যবহার সম্পর্কে জনগণের মাঝে সচেতনতা তৈরি করতে হবে।
কৃষকদের ভূমিকা
বোরো মৌসুমে কৃষকেরা ভালো ফলন করলেও বাজারে মূল্য স্থিতিশীল না থাকায় তাদের লাভের সুযোগ কমে যায়। কৃষকদের উৎপাদিত চালের ন্যায্য মূল্য পেতে হলে বাজারের প্রভাবশালী দখলদারদের নিয়ন্ত্রণ অপরিহার্য।
চালের দাম বৃদ্ধি নিয়ে দেশের গ্রামীণ ও শহুরে অর্থনীতি দুই জায়গাতেই নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। বাজারে পর্যাপ্ত চাল সরবরাহ এবং সরকারের সক্রিয় হস্তক্ষেপ ছাড়া দামের স্থিতিশীলতা আসা কঠিন। বিশেষ করে কোরবানির ঈদ ও বর্ষার মৌসুমে চালের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখা সরকারের বড় দায়িত্ব।
সাশ্রয়ী মূল্যে চাল নিশ্চিত করতে হলে সবাইকে—সরকার, মিলার, পাইকার ও ক্রেতাদের একযোগে কাজ করতে হবে। দেশবাসীর খাদ্য নিরাপত্তা রক্ষায় বর্তমান সংকট দ্রুত সমাধান করা অতীব জরুরি।
কীভাবে দাম বাড়লো? কী করবেন আপনি?
আপনার মতামত এবং চলমান বাজার পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করতে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করুন।