কাঠলিচু ও পিচের চাহিদা বৃদ্ধি, জমজমাট বাজার

গ্রীষ্ম এবং বর্ষার ঋতুতে বাজারে নানা ধরনের মৌসুমি ফলের আনাগোনা দেখা যায়। আম, কাঁঠাল, লিচুসহ বিভিন্ন ফল যেমন জনপ্রিয়, তেমনি এক বিশেষ ফল যাকে স্থানীয় ভাষায় কাঠলিচু বা পিচ ফল বলা হয়, তার চাহিদা ও বিক্রি ব্যাপক হারে বেড়েছে। এই বাদামি রঙের ছোট আকারের ফলটি দেশজুড়ে পাওয়া গেলেও এর প্রধান উৎপাদন ও সরবরাহ হয় মানিকগঞ্জের বিভিন্ন এলাকা থেকে।
কাঠলিচু – পরিচিতি ও বৈশিষ্ট্য
কাঠলিচু (বৈজ্ঞানিক নাম: Dimocarpus longan) বা আঞ্চলিকভাবে আঁশফল নামে পরিচিত এই ফলটি দেখতে লিচুর মতো হলেও অনেকটা ছোট এবং বাদামি রঙের। এটি বাংলাদেশে ঐতিহ্যবাহী মৌসুমি ফলের মধ্যে একটি, যা মূলত মানিকগঞ্জ জেলার দোহার, নবাবগঞ্জ, সিঙ্গাইর ও সদর এলাকায় প্রাকৃতিকভাবেই জন্মায়।
ফলের গায়ে মসৃণ খোসা থাকলেও ভিতরে থাকে মিষ্টি ও রসালো সাদা মাংস, যা ভিটামিন সি, শর্করা ও খনিজ সমৃদ্ধ। এই পুষ্টিগুণের কারণে স্বাস্থ্যসচেতন মানুষদের মধ্যে কাঠলিচুর জনপ্রিয়তা বাড়ছে।
বাজারে কাঠলিচুর চাহিদা বৃদ্ধি
মানিকগঞ্জ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক রবীআহ নূর আহমেদ বলেন, “জয়পুরহাটসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় এই ফল পাওয়া গেলেও মানিকগঞ্জেই এর সবচেয়ে বেশি উৎপাদন হয়। গত কয়েক বছরে কাঠলিচুর চাহিদা দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে, কারণ এটি পুষ্টিগুণে ভরপুর এবং বাজারে সহজলভ্য।”
রাজধানীর কারওয়ান বাজার থেকে শুরু করে পান্থপথের বিভিন্ন ফলের দোকানে কাঠলিচুর সরবরাহ ব্যাপক। এখানে টুকরিতে করে বিক্রি হলেও দাম অপেক্ষাকৃত বেশি হওয়ায় অনেকেই বেশি পরিমাণে কেনেন না। বিক্রেতারা জানান, কেজিপ্রতি দাম সাধারণত ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা, তাই দৈনিক গড় বিক্রি ১.৫ থেকে ২ কেজির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে।
বিক্রেতাদের কথা
কারওয়ান বাজারের ফল ব্যবসায়ী তারেকুল ইসলাম বলেন, “আমরা পাইকারি মূল্যে ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকায় কাঠলিচু সংগ্রহ করি এবং খুচরা দামে ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকায় বিক্রি করি। পূর্বে এর চাহিদা খুব বেশি ছিল না, কিন্তু এখন ক্রেতাদের সংখ্যা দ্রুত বেড়েছে।”
অন্যদিকে, রাজধানীর পান্থপথে টুকরিতে কাঠলিচু বিক্রি করছেন খলিল উদ্দীন। তিনি জানান, “এই ফলের চাহিদা এখনও সীমিত, কিন্তু যারা জানেন তারা নিয়মিত কেনেন। প্রতিদিন প্রায় দেড় থেকে দুই কেজি বিক্রি হয়।”
ফলের চাষ ও সংরক্ষণ
মানিকগঞ্জের দোহার, নবাবগঞ্জ ও সিঙ্গাইরের রাস্তার পাশে, বাড়ির আঙিনায়, এমনকি পরিত্যক্ত জমিতেও কাঠলিচুর গাছ সহজেই চোখে পড়ে। স্থানীয়রা বাদুড় এবং অন্যান্য পাখির আক্রমণ থেকে ফলকে রক্ষা করার জন্য গাছগুলো মশারি দিয়ে ঢেকে রাখেন। বাদুড় এক রাতেই গাছের সব ফল খেয়ে ফেলতে পারে, তাই এই পদক্ষেপ জরুরি।
প্রাকৃতিক কৃষি প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়কারী দোলোয়ার জাহান বলেন, “গত দুই থেকে চার বছরে কাঠলিচুর বাজার ও চাহিদা অনেক বেড়েছে। আমরা মোহাম্মদপুরের বিক্রয়কেন্দ্র এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই ফল বিক্রি করে থাকি। একটি মৌসুমে প্রায় ১৫০০ থেকে ২০০০ কাঠলিচু বিক্রি হয়।”
বাজার পরিস্থিতি ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
ফল ব্যবসায়ীরা আশা করছেন, আগামী এক মাস কাঠলিচুর সরবরাহ অব্যাহত থাকবে। লিচুর মৌসুম শেষ হওয়ার পরপরই কাঠলিচু বাজার দখল করে নেয়। যদিও বাণিজ্যিকভাবে চাষ শুরু হয়নি, স্থানীয়ভাবে গাছের পরিচর্যা ও নতুন গাছ লাগিয়ে উৎপাদন বাড়ানো হচ্ছে।
অন্যদিকে, এই ফলের গাছ তুলনামূলক কম পরিচর্যা ও সার ব্যবহার ছাড়াই ফল দেয় বলে কৃষক ও বিক্রেতাদের মধ্যে ব্যাপক আগ্রহ তৈরি হয়েছে। ফলে আগামী দিনে কাঠলিচু চাষ বাড়তে পারে বলে মনে করছেন কৃষি বিশেষজ্ঞরা।
কাঠলিচু খাদ্যশিল্পে
বিভিন্ন রেস্তোরাঁ ও ক্যাটারিং সার্ভিসেও কাঠলিচুর চাহিদা বাড়ছে। এটি মিষ্টি, আচার, জেলি বা ফলের সালাদের অন্যতম উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এর স্বাদ ও পুষ্টিগুণের কারণে এটি একটি নতুন মাত্রা যোগ করছে বাংলাদেশি খাদ্য সংস্কৃতিতে।
মানিকগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী কাঠলিচু বা পিচ ফল এখন শুধুমাত্র স্থানীয় পর্যায়ে নয়, রাজধানীর প্রধান বাজারগুলোতেও ব্যাপক পরিচিতি পাচ্ছে। পুষ্টিগুণ ও স্বাদের কারণে এই ফল ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। বাণিজ্যিকভাবে চাষ না হলেও স্থানীয় বাজারে এর চাহিদা ও বিক্রি দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে আগামী দিনগুলোতে কাঠলিচু বাংলাদেশের ফলের বাজারে এক নতুন ও প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান লাভ করবে বলে আশা করা হচ্ছে।