বানিজ্য

চট্টগ্রাম বন্দরের এনএমসিটি পরিচালনায় নৌবাহিনী

বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ও গুরুত্বপূর্ণ বন্দর চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (NCT) আগামী ছয় মাসের জন্য নৌবাহিনী পরিচালনায় আসছে। এই সিদ্ধান্ত নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় ও চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের মধ্যে অনুষ্ঠিত বৈঠকের পর নেওয়া হয়েছে। সচিবালয়ে বুধবার এক সংবাদ সম্মেলনে নৌপরিবহন উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

ছয় মাসের মেয়াদে নৌবাহিনীর দায়িত্ব নেওয়া

গত মঙ্গলবার অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদের সভায় এই সিদ্ধান্ত নীতিগত অনুমোদন পায়। এরপর বুধবার বন্দর কর্তৃপক্ষ ও নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের বৈঠকে চূড়ান্ত চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে নৌবাহিনীকে এই গুরুত্বপূর্ণ টার্মিনাল পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। টার্মিনাল পরিচালনার জন্য নির্দিষ্ট খরচের মধ্যে কার্যক্রম চালানোর শর্ত রয়েছে।

নিউমুরিং টার্মিনালে জাহাজ থেকে গ্যান্ট্রি ক্রেনের মাধ্যমে আমদানি করা কনটেইনার নামানো ও রপ্তানি পণ্যবাহী কনটেইনার জাহাজে তোলার কাজ হয়। এছাড়া, কনটেইনার সংরক্ষণ, স্থানান্তর এবং খুলে পণ্য খালাস করাও এখানেই সম্পন্ন হয়।

পূর্বে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করতো টার্মিনাল

গত ১৭ বছর ধরে দেশের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ‘সাইফ পাওয়ারটেক লিমিটেড’ এই টার্মিনালটি পরিচালনা করে আসছিল। ৬ জুলাই তাদের চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে যাচ্ছে। ৭ জুলাই থেকে নৌবাহিনী টার্মিনালের পুরো কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্ব নেবে।

নৌপরিবহন উপদেষ্টা এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, “আগের প্রতিষ্ঠানটি নৌবাহিনীকে সহযোগিতা করবে। যারা এখানে চাকরি করেন, তাদের কেউ চাকরি হারাবেন না। কেউ বাদ পড়বে না। নতুন কোনো সংকট হবে না।”

টার্মিনালের গুরুত্ব ও অবকাঠামো

নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনালটি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ও ব্যস্ততম টার্মিনাল। এখানে মোট পাঁচটি জেটি রয়েছে, যাদের মধ্যে চারটি সমুদ্রগামী জাহাজ এবং একটি অভ্যন্তরীণ নৌপথে চলাচলকারী জাহাজ গ্রহণ করতে সক্ষম। এখানে প্রতিদিন হাজার হাজার কনটেইনার ওঠানো-নামানো, সংরক্ষণ ও স্থানান্তরের কাজ হয়।

দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা: ডিপি ওয়ার্ল্ডের সঙ্গে চুক্তি

আওয়ামী লীগের শাসনামলে এই টার্মিনাল সংযুক্ত আরব আমিরাতের ডিপি ওয়ার্ল্ডের হাতে হস্তান্তরের প্রক্রিয়া শুরু হয়। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার সেই প্রক্রিয়াকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। সরকারি পরিকল্পনা অনুযায়ী, আগামী নভেম্বর মাসে ডিপি ওয়ার্ল্ডের সঙ্গে চুক্তি সম্পন্ন হওয়ার কথা রয়েছে।

বিশ্বব্যাংকের সহযোগী প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স করপোরেশন (আইএফসি) বাংলাদেশের পক্ষে এই টার্মিনালের ট্রানজেকশন অ্যাডভাইজার বা মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করছে। তাদের চুক্তি কার্যকর হওয়া পর্যন্ত এই টার্মিনালের পরিচালনা নৌবাহিনীর হাতে থাকবে।

চট্টগ্রাম বন্দরের গুরুত্ব ও অর্থনৈতিক প্রভাব

চট্টগ্রাম বন্দর দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর এবং জাতীয় অর্থনীতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। দেশের ৯০% আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য এই বন্দরের মাধ্যমে ঘটে থাকে। নিউমুরিং টার্মিনালের সুষ্ঠু ও কার্যকর পরিচালনা দেশের বাণিজ্যে প্রভাব ফেলে।

নারী-পুরুষ নির্বিশেষে হাজার হাজার কর্মীর কাজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই এই সিদ্ধান্তের অন্যতম লক্ষ্য। পাশাপাশি, বন্দরের আধুনিকায়ন ও দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে বাণিজ্যিক কার্যক্রমে গতি আনা হবে।

নৌবাহিনীর ভূমিকা ও দক্ষতা

বাংলাদেশ নৌবাহিনী দীর্ঘদিন ধরেই দেশের গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো ও সমুদ্র নিরাপত্তায় কাজ করে আসছে। বন্দরের মতো বৃহৎ কার্যক্রম পরিচালনায় তাদের অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা রয়েছে। নৌবাহিনী পরিচালনায় বন্দরের কার্যক্রমে স্বচ্ছতা ও দক্ষতা বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করা হচ্ছে।

সংশ্লিষ্টদের প্রতিক্রিয়া ও ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা

সাইফ পাওয়ারটেক লিমিটেডের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, তারা নৌবাহিনীর সঙ্গে সমন্বয় করে টার্মিনাল পরিচালনায় সহযোগিতা করবে। বন্দর কর্তৃপক্ষ ও নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় ভবিষ্যতে আরো আধুনিক প্রযুক্তি ও অবকাঠামো সংযোজনের পরিকল্পনা নিয়েছে।

বিশ্লেষকরা মনে করেন, সাময়িক হলেও নৌবাহিনীর নিয়ন্ত্রণ বন্দরের নিরাপত্তা ও কার্যকারিতা বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে। দীর্ঘমেয়াদে ডিপি ওয়ার্ল্ডের সঙ্গে চুক্তি হলে উন্নতমানের বন্দর সেবা পাওয়া সম্ভব হবে।

সংক্ষিপ্ত সারাংশ:

  • চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল ৬ মাসের জন্য নৌবাহিনী পরিচালনায় যাচ্ছে।
  • ১৭ বছর ধরে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করলেও চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ায় পরিবর্তন হচ্ছে।
  • টার্মিনাল পরিচালনায় নৌবাহিনী ও বর্তমান প্রতিষ্ঠান একসঙ্গে কাজ করবে, কারো চাকরি যাবে না।
  • বন্দর দেশের অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র, তাই টার্মিনাল পরিচালনায় স্বচ্ছতা ও দক্ষতা বাড়ানো প্রয়োজন।
  • দীর্ঘমেয়াদে সংযুক্ত আরব আমিরাতের ডিপি ওয়ার্ল্ড এই টার্মিনালের দায়িত্ব গ্রহণ করবে।
মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button