চট্টগ্রাম বন্দরে রপ্তানি কনটেইনার জট, ব্যবসায়িক ক্ষতি

চট্টগ্রাম থেকে দেশের রপ্তানি পণ্য বিশ্ববাজারে পৌঁছাতে বিঘ্ন, এনবিআরের শাটডাউনের প্রভাব বেড়ে চলেছে
চট্টগ্রাম বন্দর ও এর আশপাশের ডিপোগুলোতে বর্তমানে প্রায় ১৪ হাজার কনটেইনার রপ্তানির জন্য আটকা পড়েছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)-এর কর্মচারীদের দুই দিনের ‘শাটডাউন’ কর্মসূচির কারণে গত শনিবার ও রোববার বন্দরে কোনো কার্যক্রম সম্পূর্ণরূপে বন্ধ থাকায় এ অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে।
গত শনিবার একমাত্র দিনে ৬৩টি কনটেইনার রপ্তানি পণ্য বন্দর থেকে ওঠানো সম্ভব হয়নি। পরের দিনে তিনটি প্রধান জাহাজে ৩ হাজার ৬শ’ ৮০ কনটেইনার রপ্তানি ব্যাহত হয়। ফলে বন্দর ও শিপিং এজেন্টদের ক্ষতির পাশাপাশি দেশের অন্যতম বৃহত্তম শিল্প—পোশাক শিল্প উল্লেখযোগ্য পরিমাণ আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে।
বন্দরে আটকে পড়া কনটেইনার, পোশাক শিল্পের বড় ধাক্কা
চট্টগ্রামের বিভিন্ন ডিপোতে জমে থাকা কনটেইনারগুলোর অধিকাংশই পোশাকশিল্পের পণ্য, যেগুলো বিশ্ববাজারে পাঠানোর কথা ছিল। এশিয়ান-ডাফ গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম. এ. সালাম জানিয়েছেন, “আটকে পড়া কনটেইনারের পণ্যসম্ভার আর সময়মতো ক্রেতার কাছে পৌঁছাতে পারবে না। দুই দিনের কর্মসূচিতে পোশাক শিল্পের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে।”
বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ ও অন্যান্য গন্তব্যে রপ্তানির জন্য প্রস্তুত এসব পণ্য এখন বিলম্বিত হওয়ায় বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি খাতে বড় ধরনের আঘাত হয়েছে।
কর্মসূচির কারণে বন্দরে গতি বন্ধ
কাস্টমস কর্মকর্তা-কর্মচারীদের শাটডাউনের কারণে দুই দিনের কোনো দিনেই কাস্টমসের অনুমোদন ছাড়া জাহাজ থেকে কনটেইনার নামানো বা আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম করা সম্ভব হয়নি। শনিবার, কোনো নতুন অনুমোদন না থাকার কারণে পুরো বন্দরের কার্যক্রম বন্ধ ছিল। আগের দিনের অনুমোদন অনুযায়ী মোট ১৩৯টি কনটেইনার খালাস করা হয়েছে, তবে সেটিও সামান্যই।
রোববার পরিস্থিতি আরও সংকটজনক হয়, কারণ তিনটি জাহাজ যথাসময়ে বন্দর ছেড়ে যেতে পারেনি। ‘এএস সিসিলিয়া’ নামের একটি জাহাজে ছিল ৫৬৪টি কনটেইনার, যা সিঙ্গাপুরে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল। সেখান থেকে ইউরোপ ও আমেরিকাগামী বড় জাহাজে স্থানান্তর করার পরিকল্পনা ছিল। অন্য দুটি জাহাজ ‘এক্সপ্রেস নিলওয়ালা’ ও ‘হং ডা জিন-৬৮’ এ যথাক্রমে ১,৪৬০ ও ১,৬৬৬ কনটেইনার ছিল।
মেডিটেরানিয়ান শিপিং কোম্পানির হেড অব অপারেশনস ও লজিস্টিকস আজমীর হোসেন চৌধুরী জানিয়েছেন, “রপ্তানি কনটেইনার না পেয়ে এই তিন জাহাজই বন্দর থেকে রওয়ানা দিতে পারেনি এবং এখন জেটিতে অলসভাবে অপেক্ষা করছে।”
বন্দর চত্বরে কনটেইনারের চরম ভিড়, আমদানি-রপ্তানিতে বিশাল বাধা
কর্মসূচির কারণে সাগরে অপেক্ষমাণ জাহাজের সংখ্যা বেড়ে ১৩টি থেকে ২১টিতে উন্নীত হয়েছে। বন্দর চত্বরে থাকা কনটেইনারের সংখ্যা দুই দিনের মধ্যে প্রায় ২ হাজার থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪১ হাজারের উপরে। এতে বন্দর পরিচালনায় বড় ধরনের জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে।
চট্টগ্রাম বন্দর সচিব ওমর ফারুক জানান, “কাস্টমস কর্মসূচির কারণে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম বন্ধ থাকার ফলে বন্দর এলাকায় জমে থাকা কনটেইনার ও অপেক্ষমাণ জাহাজের সংখ্যা বেড়েছে, যার কারণে বন্দর পরিচালনা ব্যাহত হচ্ছে।”
সরকার ব্যবস্থা নেয়ার পর সন্ধ্যার পর শুরু হয়েছে কাজ
সরকার গতকালই এনবিআরের সকল কর্মচারীকে ‘অত্যাবশ্যকীয় সেবা প্রদানকারী’ হিসেবে ঘোষণা করে এবং কর্মস্থলে ফেরার আহ্বান জানায়। এরপর চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে সীমিত আকারে কিছু কাজ শুরু হয়। বেসরকারি কনটেইনার ডিপো সমিতির মহাসচিব রুহুল আমিন সিকদার জানান, সন্ধ্যার পর ডিপোগুলোতে শুল্কায়ন প্রক্রিয়া পুনরায় শুরু হয়েছে।
তবে, দুই দিনের শাটডাউনের প্রভাব কাটিয়ে ওঠার জন্য বন্দর, শিপিং এজেন্ট ও রপ্তানি খাতকে এখনও অনেক সময় ও শ্রম দিতে হবে।
বিশ্লেষণ: এনবিআরের কর্মসূচি ও বাণিজ্যের ক্ষতি
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কর্মসূচি যেভাবে দেশের বাণিজ্যিক প্রবাহ ব্যাহত করেছে, তা বাংলাদেশ অর্থনীতির জন্য মারাত্মক আশঙ্কার সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে পোশাক খাতের মতো প্রাধান্যপ্রাপ্ত রপ্তানি শিল্পের জন্য এই ধরনের বাধা দীর্ঘমেয়াদে ব্যবসায়িক বিশ্বাস ও ক্রেতাদের আস্থা হ্রাস করতে পারে।
শুল্কায়নের ঝামেলা, কাস্টমসের অনুমোদনে বিলম্ব ও কর্মচারীদের আন্দোলন—এসব বিষয় নিয়ে বাণিজ্যিক সেক্টরের মধ্যে উদ্বেগ বাড়ছে। দ্রুত ও কার্যকর সমাধান ছাড়া বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে প্রভাব পড়া অবশ্যম্ভাবী।
- সরকার ও এনবিআরের উচিত, কর্মচারীদের সাথে আলোচনা করে এমন পরিকল্পনা করা যা রপ্তানি-আমদানির কার্যক্রম বন্ধ না করে সমস্যা সমাধান করবে।
- রপ্তানি পণ্য দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য বন্দর ও ডিপোগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।
- ভবিষ্যতে কর্মচারী আন্দোলনের ফলে বাণিজ্যে বিরূপ প্রভাব পড়া থেকে রক্ষা পেতে পর্যাপ্ত বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি।
দুটি দিনের কর্মসূচির কারণে দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক প্রবাহ পুরোপুরি ব্যাহত হয়েছে এবং প্রায় ১৪ হাজার কনটেইনারের পণ্য আটকা পড়েছে। পোশাক খাতসহ রপ্তানি খাতের বড় ক্ষতি হয়েছে যা দেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দ্রুত কার্যকর উদ্যোগ না নিলে এই পরিস্থিতি দেশের বাণিজ্যিক প্রতিযোগিতার জন্য বড় ধরনের হুমকি হয়ে দাঁড়াবে।