বানিজ্য

ট্রাম্পের পাল্টা শুল্কে পোশাকের দাম বাড়ছে: এইচঅ্যান্ডএম সিইও

যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসনের নতুন পাল্টা শুল্ক নীতির প্রভাব পড়তে শুরু করেছে আন্তর্জাতিক খুচরা বাজারে। শুল্ক বৃদ্ধির ফলে পোশাকপণ্যের দাম বাড়তে শুরু করেছে বলে জানিয়েছেন সুইডিশ ফ্যাশন জায়ান্ট এইচঅ্যান্ডএম-এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ড্যানিয়েল আরভেয়ার। এ পরিস্থিতিতে প্রতিষ্ঠানটি একদিকে ক্রেতার সংবেদনশীলতা, অন্যদিকে মূল্যস্ফীতির চাপ সামলাতে নিজেদের কৌশল নতুনভাবে সাজাচ্ছে।

বিশ্বখ্যাত ব্রিটিশ দৈনিক দ্য গার্ডিয়ান–কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ড্যানিয়েল আরভেয়ার বলেন, “আমরা লক্ষ্য করছি, যুক্তরাষ্ট্রে অনেক প্রতিষ্ঠান ইতিমধ্যেই দাম বাড়াতে শুরু করেছে। কেউ কেউ আগ্রাসী কৌশলে দাম বাড়াচ্ছে, আবার কেউ ধীরগতিতে এগোচ্ছে।”

বাজারে অনিশ্চয়তা, দাম বাড়লেও বিক্রি নিশ্চিত করতে চায় ব্র্যান্ডগুলো

পোশাকের দামে এই ঊর্ধ্বগতি কতটা প্রভাব ফেলবে মার্কিন বাজারে—তা এখনও নিশ্চিত নয় বলে মনে করছেন এইচঅ্যান্ডএম সিইও। তবে তার মতে, ট্রাম্প প্রশাসনের একাধিক নীতিগত পরিবর্তন এবং হঠাৎ করে গৃহীত সিদ্ধান্তের কারণে আন্তর্জাতিক ফ্যাশন কোম্পানিগুলোর মধ্যে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে।

“পরিস্থিতি খুব দ্রুত বদলে যাচ্ছে,” বলেন আরভেয়ার। “প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্র বারবার আমদানি শুল্কের নিয়মাবলি পরিবর্তন করছে। এর ফলে আমরা নির্দিষ্ট কৌশল স্থির করে এগোতে পারছি না।”

তবে, এই অনিশ্চয়তা সত্ত্বেও এইচঅ্যান্ডএম প্রতিযোগিতামূলক মূল্য, আধুনিক ফ্যাশন এবং টেকসই পরিবেশবান্ধব উৎপাদনে নিজেদের অবস্থান ধরে রাখতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ বলে জানান তিনি।

উৎপাদন খরচ বাড়লেও মূল্য কম রাখতে চাপ

বিশ্বব্যাপী শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি বৃদ্ধি, পরিবহন ব্যয় ও শুল্ক বৃদ্ধির ফলে পোশাক উৎপাদনের খরচ অনেক বেড়ে গেছে। অথচ একই সময়ে এইচঅ্যান্ডএম-এর মতো ব্র্যান্ডগুলো ক্রেতাদের জন্য দাম স্থিতিশীল রাখার চাপের মুখে রয়েছে।

আরভেয়ার বলেন, “বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা, মুদ্রাস্ফীতি এবং পরিবারের আয় ব্যয়ে ভারসাম্যহীনতার কারণে ভোক্তারা এখন প্রতিটি টাকাই হিসাব করে খরচ করছে। ফলে তারা দামের ব্যাপারে অত্যন্ত সংবেদনশীল হয়ে উঠেছে।”

এ প্রেক্ষাপটে প্রতিষ্ঠানটি আগামী মাসগুলোতে মূল্যছাড় বা ডিসকাউন্ট অফারের পরিমাণ আরও বাড়াতে পারে বলে জানানো হয়েছে। কারণ, অনিশ্চিত অর্থনীতির মধ্যে ভোক্তাদের মধ্যে কেনাকাটার আগ্রহ তৈরি করতে এখন অনেক ব্র্যান্ডই দাম কমিয়ে দিচ্ছে।

শাখা বন্ধের সিদ্ধান্ত ও প্রযুক্তিনির্ভর সেবায় জোর

২০২৫ সালের মধ্যে এইচঅ্যান্ডএম তাদের বিশ্বব্যাপী ৪২০০টি স্টোরের মধ্যে প্রায় ২০০টি বন্ধ করে দেবে বলে জানিয়েছে। তবে একই সময়ে ৮০টি নতুন স্টোর খোলার পরিকল্পনাও রয়েছে, যা নতুন বাজারে প্রবেশ ও টেকসই কৌশলের অংশ হিসেবে দেখা হচ্ছে।

আরও উল্লেখযোগ্য হলো, প্রতিষ্ঠানটি শ্রম ব্যয় হ্রাস এবং কার্যকারিতা বাড়াতে দোকানগুলোতে সেলফ-চেকআউট ব্যবস্থা চালু করছে। অর্থাৎ, ক্রেতারা নিজেরাই পণ্যের দাম পরিশোধ করতে পারছেন—যা পশ্চিমা বাজারে ইতোমধ্যেই ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে।

পাশাপাশি পোশাকের ভেতরে ব্যবহার করা হচ্ছে স্মার্ট রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি আইডেনটিফিকেশন (আরএফআইডি) ট্যাগ, যার মাধ্যমে একসঙ্গে বহু পণ্য স্ক্যান করে দ্রুত হিসাব করা যাচ্ছে।

পাল্টা শুল্ক: কোথা থেকে শুরু?

চলতি বছরের ২ এপ্রিল মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নতুন ‘রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ’ বা পাল্টা শুল্ক নীতির ঘোষণা দেন। এর আওতায় যুক্তরাষ্ট্র যেসব দেশ থেকে প্রচুর পণ্য আমদানি করে, তাদের ওপর অন্তত ১০ শতাংশ হারে শুল্ক আরোপ করা হয়।

একইসঙ্গে বিশ্বের ৫৭টি দেশের ওপর বিভিন্ন হারে অতিরিক্ত শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেন ট্রাম্প। যদিও মাত্র এক সপ্তাহ পর, ৯ এপ্রিল, এ শুল্ক তিন মাসের জন্য স্থগিত করা হয়। তবে এরমধ্যেই ন্যূনতম ১০ শতাংশ হারে শুল্ক কার্যকর করা হয় অধিকাংশ দেশের পণ্যের ওপর।

বিশ্লেষকরা বলছেন, ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্ত মূলত মার্কিন শিল্পকে সুরক্ষা দেওয়ার লক্ষ্যেই নেওয়া হয়েছে। কিন্তু এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে আন্তর্জাতিক সরবরাহ চেইনে, যা একাধিক খুচরা ব্র্যান্ডের ব্যবসা ঝুঁকির মুখে ফেলছে।

আন্তর্জাতিক পোশাক শিল্পে প্রভাব

বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ পোশাক আমদানিকারক যুক্তরাষ্ট্রে এই ধরনের শুল্ক আরোপ বিশ্বব্যাপী সরবরাহ চেইনের ওপর চাপ তৈরি করছে। চীন, বাংলাদেশ, ভিয়েতনামসহ বহু দেশের পোশাক কারখানাগুলোর জন্য মার্কিন বাজার খুব গুরুত্বপূর্ণ।

এইচঅ্যান্ডএমসহ অন্যান্য ব্র্যান্ড এই পণ্যগুলোর অনেকটাই এসব দেশ থেকে আমদানি করে থাকে। ফলে শুল্ক বৃদ্ধির ফলে তাদের পণ্যের বিক্রয়মূল্য বাড়ছে এবং একইসঙ্গে লাভের হারও কমছে।

পোশাক শিল্প সংশ্লিষ্ট বিশ্লেষকরা বলছেন, এই পরিস্থিতি দীর্ঘস্থায়ী হলে অনেক ব্র্যান্ড বিকল্প বাজার খুঁজতে বাধ্য হবে এবং একইসঙ্গে উৎপাদনের স্থানান্তরও ঘটতে পারে।

টেকসই ভবিষ্যতের পথে এইচঅ্যান্ডএম

এমন সংকটকালেও এইচঅ্যান্ডএম তাদের ‘সাসটেইনেবল ফ্যাশন’ বা টেকসই ফ্যাশন উদ্যোগকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। কোম্পানিটি পুনর্ব্যবহারযোগ্য কাপড়, কম পানি ব্যবহারকারী প্রযুক্তি, এবং পরিবেশবান্ধব উৎপাদনের দিকেই ধীরে ধীরে এগোচ্ছে।

তাদের লক্ষ্য শুধু ব্যবসায়িকভাবে টিকেই থাকা নয়, বরং গ্রহের প্রতি দায়বদ্ধতা রেখে একটি দায়িত্বশীল ফ্যাশন শিল্প গড়ে তোলা।

এইচঅ্যান্ডএম-এর সিইও আরভেয়ার বলেন, “বর্তমানে শুধু দামে প্রতিযোগিতা করলেই চলবে না। গ্রাহকরা এখন পরিবেশের প্রতিও সচেতন। তাই আমরা পরিবেশবান্ধব এবং ন্যায্য বাণিজ্য নিশ্চিত করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।”

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button