বানিজ্য

কোরবানির ঈদের পর চাল ও সবজির দাম বৃদ্ধি

কোরবানির ঈদ পার হওয়ার প্রায় তিন সপ্তাহ অতিবাহিত হলেও ঢাকার বাজারে চাল ও সবজির দাম আগের থেকে অনেক বেশি বেড়ে গেছে। বিশেষ করে মিনিকেট চালের দাম কেজিতে পাঁচ থেকে ছয় টাকা পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। মোটা এবং মাঝারি চালের দামও কম-বেশি দুই টাকা বাড়ার খবর পাওয়া গেছে। এর পাশাপাশি বিভিন্ন প্রকার সবজির দামেও সামান্য বৃদ্ধি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। রাজধানীর মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেট, টাউন হল বাজার এবং কারওয়ান বাজারের বিভিন্ন দোকান ও পাইকারি বাজার ঘুরে এই তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে।

বাজারে চালের মূল্যবৃদ্ধির কারণ ও পরিসংখ্যান

বোরো ধান কাটার সময় হওয়ার পরও চালের দাম কুড়ি দিনের বেশি সময় ধরে বাড়তে থাকা বিষয়টি ক্রেতাদের মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, মূলত বোরো ধানের উৎপাদন স্থলে মূল্য বৃদ্ধির প্রভাব বাজারে সরাসরি পড়ছে। মিনিকেট চাল, যা বোরো ধান থেকে তৈরি হয়, তার দাম বেড়ে যাওয়ায় মোটা ও মাঝারি চালের দামও সারা বাজারে বৃদ্ধি পাচ্ছে।

ঢাকার খুচরা বাজারে বর্তমানে ডায়মন্ড, মঞ্জুর, সাগর, রসিদ, মোজাম্মেল প্রভৃতি ব্র্যান্ডের মিনিকেট চালের দাম কেজিতে ৮০ থেকে ৮২ টাকার মধ্যে। ঈদের আগে এই দাম ছিল ৭৫ থেকে ৭৬ টাকা। অর্থাৎ দাম বেড়েছে ৫-৬ টাকা। মোজাম্মেল ব্র্যান্ডের চালের দাম তুলনামূলক একটু বেশি, যা বর্তমানে ৮৫ থেকে ৯০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এর আগে ঈদের সময় এই চালের দাম ছিল প্রায় ৮০ টাকা।

সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) এর তথ্য অনুযায়ী, গত এক সপ্তাহে সরু চালের দাম কেজিতে তিন টাকা এবং মোটা ও মাঝারি চালের দাম এক টাকার মতো বেড়েছে। মোটা চালের মধ্যে ‘স্বর্ণা’ ব্র্যান্ডের দাম কেজিতে দুই টাকা বেড়ে ৫৫ থেকে ৫৭ টাকা পর্যন্ত উঠেছে। এছাড়া ব্রি-২৮ ও ব্রি-২৯ জাতের মাঝারি চালের দামও দুই টাকা বাড়িয়ে ৬০ থেকে ৬২ টাকা হয়েছে।

সবজির দামেও ঊর্ধ্বগতি, আলু ও টমেটোর দাম বেড়েছে

এক সপ্তাহের ব্যবধানে কিছু সবজির দাম বেড়ে গেছে। টমেটোর দাম বর্তমানে প্রতি কেজি ১২০ থেকে ১৮০ টাকার মধ্যে রয়েছে, যা সপ্তাহখানেক আগে ছিল ১০-২০ টাকা কম। বরবটি, কাঁকরোল, কাঁচা মরিচের দাম ৮০ থেকে ১০০ টাকা এবং পটোল, ধুন্দল, চিচিঙ্গা, ঢ্যাঁড়সের দাম ৪০ থেকে ৫০ টাকার মধ্যে উঠানামা করছে। বেগুনের দামও ৬০ থেকে ১০০ টাকা পর্যন্ত দেখা গেছে।

বিশেষ করে আলুর দাম বৃদ্ধিই ক্রেতাদের সবচেয়ে বেশি অনুভূত হচ্ছে। ঈদের আগে আলু কেজি প্রতি ২০ থেকে ২৫ টাকায় বিক্রি হলেও এখন দাম বাড়িয়ে ২৫ থেকে ৩০ টাকা পর্যায়ে পৌঁছেছে। পেঁয়াজের দামও বেড়ে ৫৫ থেকে ৬০ টাকা কেজিতে উঠেছে। অন্যদিকে আমদানি করা রসুন, আদা, দারুচিনি ও এলাচের দাম সামান্য কমেছে।

মুরগি ও ডিমের দাম অপরিবর্তিত

মুরগির বাজারে এখনো বড় ধরনের মূল্যস্ফীতি দেখা যাচ্ছে না। সোনালি মুরগি প্রতি কেজি প্রায় ৩০০ টাকায়, আর ব্রয়লার মুরগি ১৫০ থেকে ১৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ডিমের দামও ডজন প্রতি ১২০ টাকার কাছাকাছি রয়েছে। তবে পাড়া-মহল্লার খুচরা বিক্রেতারা কিছুটা বেশি দাম নেয়ার প্রবণতা দেখাচ্ছেন।

সাধারণ মানুষের ভাবনা ও উদ্বেগ

রাজধানীর মোহাম্মদপুর টাউন হল বাজারের এক গৃহিণী, নাদিয়া ইয়াসমিন, বলেন, “একবার চালের দাম বেড়ে গেলে অন্য সব নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দামও বেড়ে যায়। এই নিয়ে আমাদের গৃহস্থালির বাজেট স্থির রাখা কঠিন হয়ে যাচ্ছে।” তিনি আরো যোগ করেন, “অর্থনৈতিক অবস্থা এই পর্যায়ে কঠিন হলেও দাম বেড়ে গেলে সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ বাড়ে।”

চালের দাম বৃদ্ধির পেছনের কারণ বিশ্লেষণ

বিশেষজ্ঞদের মতে, এই মূল্যবৃদ্ধির পেছনে কয়েকটি কারণ কাজ করছে। প্রথমত, উৎপাদন খাতে ধানের দাম বেড়ে যাওয়ায় সরবরাহকারীরা চালের দাম বাড়াচ্ছেন। দ্বিতীয়ত, করোনার পর বিশ্ববাজারে কৃষিপণ্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যস্ফীতি ব্যাপক। তৃতীয়ত, পরিবহন খরচ ও জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি সামগ্রিক বাজারে পণ্যের মূল্য বাড়ানোর একটি বড় কারণ।

সরকারি পদক্ষেপ ও বাজার নিয়ন্ত্রণ

সরকার ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) এর মাধ্যমে নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে বিভিন্ন সময় গণবাজার পরিচালনা করছে। টিসিবির মাধ্যমে চাল, আলু, পেঁয়াজ, ডিম ও মুরগির নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ বাড়ানো হচ্ছে যাতে বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি না হয়।

তবে ব্যবসায়ীদের একাংশ অভিযোগ করেন, সরবরাহ ব্যবস্থার কোনো অংশে অনিয়ম থাকলে তা দাম বৃদ্ধির কারণ হতে পারে। তাই বাজারে মূল্য স্থিতিশীল করতে কার্যকর পদক্ষেপ প্রয়োজন।

ভবিষ্যৎ পরিস্থিতি ও ভোক্তাদের জন্য পরামর্শ

বিশ্লেষকরা বলছেন, আগামী কয়েক মাসে ধান ও চালের বাজারে ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে দাম কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসতে পারে। তবে বিশ্ববাজারের মূল্য ওঠানামা ও অভ্যন্তরীণ সরবরাহ ব্যবস্থার ওপর নজর রাখতেই হবে।

ভোক্তাদের জন্য পরামর্শ হলো, অপ্রয়োজনীয় পণ্যে অতিরিক্ত ক্রয় থেকে বিরত থাকতে হবে এবং স্থানীয় উৎপাদিত পণ্যগুলো বেশি ব্যবহার করার চেষ্টা করতে হবে। এতে করে ব্যক্তিগত বাজেট সামঞ্জস্য থাকবে এবং বাজারেও চাপ কমবে।

সার্বিক পর্যালোচনা

বর্তমান বাজারে চাল ও সবজির দাম বৃদ্ধির প্রভাব সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায় প্রকট হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের জন্য প্রতিদিনের খাদ্যদ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি আরও কষ্টসাধ্য করে তুলেছে। সরকারি তদারকি বাড়ানো ও বাজার নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা শক্তিশালী করাই সমাধানের পথ।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button