বানিজ্য

বিশ্ববাজারে তেল ও ডলারের দাম লাফিয়ে বাড়ছে

২০২৫ সালের ২৩ জুন, সোমবার: গত কয়েকদিন ধরে বিশ্ববাজারে তেল ও ডলারের দাম উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষ করে ইরানে মার্কিন সামরিক হামলার পরে পরিস্থিতি আরো অনিশ্চিত ও উদ্বেগজনক হয়ে উঠেছে। এ খবরের পর বিশ্ব অর্থনীতির পাশাপাশি শেয়ারবাজারেও প্রভাব পড়েছে। তেলের দাম পাঁচ মাসের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে, আর ডলারের চাহিদা বাড়ার ফলে মুদ্রার মানও বৃদ্ধি পেয়েছে।

মার্কিন হামলার প্রেক্ষাপটে ইরান-আমেরিকার উত্তেজনা

গত সপ্তাহে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক হামলা সংঘটিত হওয়ার পর তেহরান থেকে পাল্টা জবাবের আশঙ্কায় বিশ্বজুড়ে বিনিয়োগকারীরা উদ্বিগ্ন। মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা বৃদ্ধি পাওয়ায় সুরক্ষা ও স্থিতিশীলতার আশঙ্কায় তেল ও অন্যান্য পণ্যের দাম বাড়ছে।

ইরান-আমেরিকার এই সংঘাত শুধু মধ্যপ্রাচ্যের স্থিতিশীলতাকেই প্রভাবিত করছে না, বরং গোটা বিশ্বের জ্বালানি বাজার ও অর্থনীতিতে প্রভাব বিস্তার করছে। তেলের দাম বাড়ার ফলে বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কাও প্রবল।

তেলের দাম বৃদ্ধি এবং হরমুজ প্রণালির গুরুত্ব

বিশ্বের জ্বালানি সরবরাহের এক চতুর্থাংশ তেল ও ২০ শতাংশ তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস পরিবহন হয় হরমুজ প্রণালির মাধ্যমে। এই জলপথটি কৌশলগত দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, এবং ইরানের ওপর এর নিয়ন্ত্রণ একটি বড় অস্ত্রস্বরূপ।

বিশ্লেষকরা বলছেন, ইরান যদি এই প্রণালি কৌশলগতভাবে বন্ধ করে দেয় বা এতে বাধা সৃষ্টি করে, তাহলে ব্রেন্ট ক্রুড তেলের দাম সহজেই ব্যারেলপ্রতি ১০০ ডলার ছুঁয়ে যেতে পারে। তবে আপাতত পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।

কমনওয়েলথ ব্যাংক অব অস্ট্রেলিয়ার পণ্য বিশ্লেষক বিবেক ধর জানান, ইরান কেবল হরমুজ প্রণালিকে পুরোপুরি বন্ধ না করে সীমিত পরিসরে ঝুঁকি সৃষ্টি করাটাই তাদের কৌশল হতে পারে। কারণ, প্রণালি বন্ধ হলেই ইরানের নিজস্ব তেল রপ্তানি বন্ধ হয়ে যাবে।

শেয়ারবাজার ও মুদ্রাবাজারের অবস্থা

মার্কিন ও ইউরোপীয় শেয়ারবাজারে সোমবার কিছুটা পতন লক্ষ্য করা গেছে। বিশেষ করে জাপান বাদে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের সূচকগুলো ০.৫ শতাংশের বেশি কমেছে। ইউরোপীয় প্রধান সূচকগুলোও পতনের মুখে, যেখানে ইউরোস্টক্স, এফটিএসই ও ডিএএক্স সূচকের পতন ছিল প্রায় ০.৫ থেকে ০.৭ শতাংশ।

ডলারের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় ডলারের মান ইয়েন এবং ইউরোর বিপরীতে বেড়েছে। তবে সোনা, যাকে সাধারণত নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে ধরা হয়, তার দাম সামান্য কমেছে। মার্কিন ট্রেজারি বন্ডেও বিনিয়োগকারীরা বড় কোনো ঝুঁকি নিতে চায়নি, ফলে সুদের হার সামান্য বাড়ার লক্ষণ দেখা গেছে।

ফেডারেল রিজার্ভ ও সুদের হার

যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভের সুদের হার নিয়ে বিভিন্ন মতামত থাকলেও, অধিকাংশ কর্মকর্তাই এখনো সুদের হার বাড়িয়ে রাখার পক্ষে। তবে কিছু কর্মকর্তা জুলাই মাসে সুদের হার কমানোর পক্ষে মতামত দিয়েছেন। আগামিকাল ও আগামী সপ্তাহে ফেডারেল রিজার্ভের কর্মকর্তারা গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য দেবেন যা বাজারের জন্য দিকনির্দেশক হতে পারে।

ফেডের সিদ্ধান্ত মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এবং অর্থনীতির স্থিতিশীলতার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইরান-আমেরিকার উত্তেজনার কারণে তেলের দাম বাড়লে যুক্তরাষ্ট্রের মূল্যস্ফীতি আরও বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে, যা ফেডের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হবে।

আগামী দিনে বৈশ্বিক অর্থনীতি ও বাজারের ওপর প্রভাব

বিশ্বের অনেক দেশ মধ্যপ্রাচ্যের উত্তেজনাকে খুব সংবেদনশীলভাবে দেখছে। বিশেষ করে ন্যাটোর আসন্ন সম্মেলনে মধ্যপ্রাচ্যের নিরাপত্তা ও সামরিক খরচ বাড়ানোর বিষয়ে আলোচনা হবে।

এছাড়া, আগামী সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য দেশের গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক সূচক প্রকাশিত হবে, যার মধ্যে রয়েছে জ্বালানি ও খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি, বেকারত্বের হারের তথ্য ও কারখানাভিত্তিক উৎপাদনের অগ্রগতি। এসব তথ্য বিশ্ব অর্থনীতির গতি নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

ইরানে মার্কিন হামলার পর বিশ্ববাজারে তেলের দাম ও ডলারের মান বেড়েছে, যা বৈশ্বিক অর্থনীতিতে অস্থিরতার সৃষ্টি করছে। তেলের সরবরাহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা হরমুজ প্রণালির নিয়ন্ত্রণ কৌশলগত সমস্যা তৈরি করতে পারে। বিনিয়োগকারীরা নিরাপদ আশ্রয়ের দিকে ঝুঁকছেন, যার প্রভাব শেয়ারবাজার ও মুদ্রাবাজারে পড়ছে। ফেডারেল রিজার্ভের সুদের হার সিদ্ধান্ত এবং ন্যাটোর বৈঠক এই সংকটের মধ্যেও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে দাঁড়িয়েছে।

বিশ্ব অর্থনীতির জন্য এই পরিস্থিতি কতটা সংকটময় হতে পারে, তা নির্ভর করছে মধ্যপ্রাচ্যের উত্তেজনার দিকনির্ভরতায়। তবে বিশ্লেষকরা মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, যাতে বৈশ্বিক বাজার স্থিতিশীল থাকে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button