বানিজ্য

পরিবেশবান্ধব কারখানার স্বীকৃতি পাচ্ছে ৩০ প্রতিষ্ঠান

দেশের শিল্পখাতে টেকসই ও পরিবেশবান্ধব উৎপাদন প্রক্রিয়াকে উৎসাহিত করতে ‘পরিবেশবান্ধব কারখানা পুরস্কার’ বা ‘গ্রিন ফ্যাক্টরি অ্যাওয়ার্ড’ প্রদান কার্যক্রম চালু করেছে সরকার। এ ধারাবাহিকতায় ২০২৫ সালের জন্য ৩০টি শিল্পপ্রতিষ্ঠানকে এ পুরস্কারের জন্য মনোনীত করা হয়েছে। আগামীকাল মঙ্গলবার রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে এক অনাড়ম্বর আয়োজনে বিজয়ী প্রতিষ্ঠানগুলোর শীর্ষ নির্বাহীদের হাতে পুরস্কার তুলে দেওয়া হবে।

শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় গত ১৯ জুন ১৬টি খাতভিত্তিক চূড়ান্ত মনোনীত প্রতিষ্ঠানগুলোর তালিকা প্রকাশ করে। ‘গ্রিন ফ্যাক্টরি অ্যাওয়ার্ড নীতিমালা–২০২০’ অনুসারে পুরস্কারপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মপরিবেশ, পরিবেশ সংরক্ষণ, টেকসই প্রযুক্তি ব্যবহার, শ্রমিকদের কল্যাণ ও শিল্পবর্জ্য ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে গৃহীত কার্যক্রম মূল্যায়ন করে এ মনোনয়ন চূড়ান্ত করা হয়েছে।

একাধিক প্রতিষ্ঠান মনোনীত তিনটি শিল্পগোষ্ঠী

তালিকায় বিশেষভাবে লক্ষ্যনীয়, তিনটি শিল্পগোষ্ঠীর একাধিক প্রতিষ্ঠান এবার পুরস্কার পাচ্ছে। এদের মধ্যে অন্যতম ট্রান্সকম গ্রুপ। প্রতিষ্ঠানটির অধীনস্থ ট্রান্সকম ইলেকট্রনিকস ও এসকেএফ ফার্মাসিউটিক্যালস এ সম্মাননা পাচ্ছে। প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের চরকা টেক্সটাইল ও হবিগঞ্জ অ্যাগ্রো এবং আকিজ গ্রুপের আকিজ টেক্সটাইল ও আকিজ ফুড অ্যান্ড বেভারেজও পুরস্কারপ্রাপ্তদের তালিকায় রয়েছে। এ ধরণের স্বীকৃতি সংশ্লিষ্ট শিল্পগোষ্ঠীর পরিবেশবান্ধব কার্যক্রমকে আরও বেগবান করবে বলে আশা করা হচ্ছে।

তৈরি পোশাক খাতের সাফল্য

তৈরি পোশাক খাত থেকে নিট সেগমেন্টে পুরস্কার পাচ্ছে তিনটি প্রতিষ্ঠান—নরসিংদীর পলাশের চরকা টেক্সটাইল, গাজীপুরের কালিয়াকৈরের ইকোটেক্স এবং নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের ফকির ফ্যাশন। ওভেন পোশাক খাত থেকে পুরস্কার পাচ্ছে মানিকগঞ্জের সাটুরিয়ার তারাসিমা অ্যাপারেলস, গাজীপুরের আউকু টেক্স এবং ময়মনসিংহের স্কয়ার ফ্যাশন।

বিশেষজ্ঞদের মতে, তৈরি পোশাক শিল্প বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি। এই খাতে পরিবেশবান্ধব কারখানার সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়াকে ইতিবাচক অগ্রগতি হিসেবে দেখা হচ্ছে।

বস্ত্র ও টেক্সটাইল খাতে চার কারখানা

বস্ত্র খাত থেকে এবার চারটি প্রতিষ্ঠানকে গ্রিন ফ্যাক্টরি অ্যাওয়ার্ড দেওয়া হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে—মানিকগঞ্জের চরকান্দার আকিজ টেক্সটাইল মিলস, হবিগঞ্জের মাধবপুরের পাইওনিয়ার ডেনিম, চট্টগ্রামের চান্দগাঁওয়ের কেডিএস টেক্সটাইল মিলস এবং পটিয়ার ফোর এইচ ডাইং অ্যান্ড প্রিন্টিং। এদের প্রত্যেকেই তাদের উৎপাদন প্রক্রিয়ায় পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ও পানি ব্যবস্থাপনার আধুনিক কৌশল ব্যবহার করে একটি সবুজ ও টেকসই কারখানা গড়ে তুলেছে।

বৈচিত্র্যময় খাতসমূহে পুরস্কারপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান

অটোমোবাইল খাতের একমাত্র মনোনীত প্রতিষ্ঠান হলো চট্টগ্রামের প্রগতি ইন্ডাস্ট্রিজ। সরকারি এই প্রতিষ্ঠানটির কারখানাটি পরিবেশ সুরক্ষায় উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে।

ইলেকট্রিক ও ইলেকট্রনিক পণ্য উৎপাদন খাতের মধ্যে পুরস্কার পাচ্ছে ট্রান্সকম ইলেকট্রনিকস (নরসিংদীর শাষপুর), ফেয়ার ইলেকট্রনিকস (শিবপুর) এবং ওয়ালটন হাইটেক ইন্ডাস্ট্রিজ (গাজীপুরের কালিয়াকৈর)। এ প্রতিষ্ঠানগুলো কার্বন নিঃসরণ হ্রাস এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।

সরঞ্জাম ও সংযোগ খাত থেকে একমাত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান ঢাকার ধামরাইয়ের আদজি ট্রিমস। খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ খাতে ধামরাইয়ের আকিজ ফুড অ্যান্ড বেভারেজ ও হবিগঞ্জের হবিগঞ্জ অ্যাগ্রো পুরস্কার পাচ্ছে।

চা–শিল্প থেকে পুরস্কারপ্রাপ্ত দুটি প্রতিষ্ঠান হচ্ছে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলের জেরিন চা–বাগান ও মির্জাপুর চা–বাগান। এই খাত সাধারণত পরিবেশঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত, তবে গ্রিন ফ্যাক্টরি মান অর্জনের জন্য প্রক্রিয়াজাতকরণ ও পানির ব্যবস্থাপনাতেও জোর দেওয়া হয়েছে।

চামড়াজাত পণ্য উৎপাদন খাত থেকে পুরস্কারপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান হলো ময়মনসিংহের ভালুকার সুনিভার্স ফুটওয়্যার। এই প্রতিষ্ঠানটি ট্যানারির বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।

পাট খাতে কারুপণ্য রংপুর এবং টাইলস অ্যান্ড সিরামিক খাতে গাজীপুরের এক্স সিরামিক এবার পুরস্কার পাচ্ছে। প্রসাধনী খাতে মুন্সিগঞ্জের রিমার্ক এইচবি ও নারায়ণগঞ্জের স্কয়ার টয়লেট্রিজ এবং ওষুধ খাতে গাজীপুরের এসকেএফ ফার্মাসিউটিক্যালসকে গ্রিন ফ্যাক্টরি স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে।

জাহাজ ভাঙা ও নির্মাণ খাত থেকে তিনটি প্রতিষ্ঠান—চট্টগ্রামের পিএইচপি শিপ ব্রেকিং অ্যান্ড রিসাইক্লিং, কেআর শিপ রিসাইক্লিং এবং খুলনার খুলনা শিপইয়ার্ড পুরস্কার পাচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে পরিবেশ দূষণের জন্য আলোচিত এ খাতে পরিবেশবান্ধব কার্যক্রম গ্রহণ করায় এই স্বীকৃতি তাৎপর্যপূর্ণ।

সিমেন্ট ও ইস্পাত খাতে যথাক্রমে সেভেন সার্কেল (কালীগঞ্জ, গাজীপুর) এবং বিএসআরএম স্টিলস (সীতাকুণ্ড, চট্টগ্রাম) পুরস্কার পাচ্ছে।

গ্রিন ফ্যাক্টরি উদ্যোগের গুরুত্ব

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, গ্রিন ফ্যাক্টরি অ্যাওয়ার্ড শিল্প উদ্যোক্তাদের মধ্যে পরিবেশ সচেতনতা বৃদ্ধি করবে এবং নতুন প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনী কার্যক্রম গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করবে। একইসঙ্গে, আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের পণ্যের প্রতিযোগিতার সক্ষমতা বাড়াতে এই উদ্যোগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

বাংলাদেশ টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনের যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, এই পুরস্কার কার্যক্রম সেই লক্ষ্যপূরণেও সহায়ক হবে।

শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, প্রতিবছরই এ ধরনের পুরস্কার প্রদান অব্যাহত থাকবে এবং মানদণ্ড আরও কঠোর করা হবে। পাশাপাশি পরিবেশবান্ধব কারখানা গঠনের জন্য সরকারি সহায়তাও বাড়ানো হবে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button