অগ্রণী ব্যাংকের এজেন্ট ব্যাংকিং সেবা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ

দেশের অন্যতম রাষ্ট্রায়ত্ত আর্থিক প্রতিষ্ঠান অগ্রণী ব্যাংক পিএলসি হঠাৎ করেই তাদের বিস্তৃত এজেন্ট ব্যাংকিং সেবা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেছে। আগামীকাল শনিবার (২১ জুন) থেকে এ সিদ্ধান্ত কার্যকর হতে যাচ্ছে। শুক্রবার (২০ জুন) বিকেলে ব্যাংকটির পক্ষ থেকে গণমাধ্যমে পাঠানো এক জরুরি বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
হঠাৎ সিদ্ধান্তে গ্রাহকদের মধ্যে চরম অসন্তোষ
অগ্রণী ব্যাংকের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, “ব্যাংক কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২১ জুন ২০২৫ থেকে পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত অনিবার্য কারণে ব্যাংকের এজেন্ট পয়েন্ট থেকে সব ধরনের ব্যাংকিং সেবা বন্ধ থাকবে।”
তবে ব্যাংকের পক্ষ থেকে সেবা বন্ধের নির্দিষ্ট কারণ প্রকাশ করা হয়নি। এই অস্পষ্ট অবস্থান গ্রাহকদের মধ্যে উদ্বেগ এবং বিভ্রান্তির জন্ম দিয়েছে। বিশেষ করে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষ, যারা নিকটস্থ কোনো শাখায় না গিয়ে এজেন্ট ব্যাংকিং সেবার ওপর নির্ভর করতেন, তারা এখন চরম দুশ্চিন্তায় পড়েছেন।
অগ্রণী ব্যাংকের এজেন্ট ব্যাংকিং কাঠামো
বর্তমানে দেশের বিভিন্ন জেলায় অগ্রণী ব্যাংকের ৫৬৭টি এজেন্ট ব্যাংকিং পয়েন্ট রয়েছে। এসব পয়েন্ট থেকে সাধারণ গ্রাহকরা সহজে নগদ জমা ও উত্তোলন, প্রবাসী আয় উত্তোলন, ইউটিলিটি বিল পরিশোধ, ক্ষুদ্র ঋণ বিতরণ, সঞ্চয় হিসাব খোলা এবং অন্যান্য প্রাথমিক ব্যাংকিং সেবা গ্রহণ করতে পারেন।
বেসরকারি ব্যাংকগুলোর পাশাপাশি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতেও এজেন্ট ব্যাংকিং বিস্তৃত হওয়ার ফলে সাধারণ মানুষের মধ্যে আর্থিক অন্তর্ভুক্তি (financial inclusion) ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। বিশেষ করে ইউনিয়ন পর্যায়ে ব্যাংকিং সেবা পৌঁছাতে এ ধরনের কার্যক্রম বড় ভূমিকা রাখে।
ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী
অগ্রণী ব্যাংকের এ সিদ্ধান্তে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হবেন গ্রামাঞ্চলে বসবাসকারী হাজার হাজার নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত গ্রাহক, যারা ব্যাংক শাখায় যেতে পারেন না বা যান না।
ফরিদপুর জেলার চরভদ্রাসনের বাসিন্দা এবং একজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী নাজিম উদ্দিন বলেন, “আমি নিয়মিত আমার বিক্রির টাকা কাছাকাছি এজেন্ট ব্যাংকিং পয়েন্টে জমা দিতাম। এখন হঠাৎ করে বন্ধ হয়ে গেলে এত টাকা নিয়ে নিরাপদে থাকা কঠিন হবে।”
একইভাবে, অনেক প্রবাসী পরিবারের সদস্য যারা মাস শেষে রেমিট্যান্সের টাকা তুলতেন এজেন্ট পয়েন্ট থেকে, তারাও এখন পড়েছেন চরম অনিশ্চয়তায়।
ব্যাংকের শাখায় সেবা চালু থাকলেও সীমাবদ্ধতা রয়ে গেছে
বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, “এজেন্ট ব্যাংকিং গ্রাহকেরা অগ্রণী ব্যাংকের যেকোনো শাখা থেকে ব্যাংকিং সেবা নিতে পারবেন।” যদিও এ ঘোষণাটি কিছুটা স্বস্তিদায়ক মনে হলেও, বাস্তবতায় তা অনেক ক্ষেত্রেই অসাধ্য। অনেক গ্রাহকের জন্য সবচেয়ে কাছের শাখায় যেতেও কয়েক কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হয়, তাও আবার সীমিত সময়ে এবং দীর্ঘ লাইনের ভোগান্তির মধ্য দিয়ে।
তাছাড়া গ্রামীণ শাখাগুলোতে জনবল সংকট ও অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা থাকার কারণে অতিরিক্ত গ্রাহকসেবা চাপ সামলানো কঠিন হয়ে উঠতে পারে।
বন্ধের নেপথ্যে সম্ভাব্য কারণ
যদিও ব্যাংক কর্তৃপক্ষ কোনো আনুষ্ঠানিক ব্যাখ্যা দেয়নি, তবে বিশ্লেষকদের মতে এর পেছনে থাকতে পারে কয়েকটি কারণ—
১. প্রযুক্তিগত নিরাপত্তা হুমকি: সাম্প্রতিক সময়ে কিছু এজেন্ট পয়েন্টে নিরাপত্তা হুমকি বা জালিয়াতির অভিযোগ উঠে থাকতে পারে।
২. ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতা: নিয়ন্ত্রণ ও পর্যবেক্ষণের অভাবে এজেন্ট পয়েন্টগুলোর কার্যক্রম সঠিকভাবে পরিচালিত না হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
৩. অডিট ও আর্থিক পর্যালোচনা: বাংলাদেশ ব্যাংক বা ব্যাংকের নিজস্ব নিরীক্ষা বিভাগের তত্ত্বাবধানে এজেন্ট ব্যাংকিং কার্যক্রমে অনিয়ম ধরা পড়তে পারে, যা সাময়িকভাবে বন্ধের দিকে নিয়ে গেছে।
৪. নতুন নিয়মাবলীর প্রয়োগ: সরকার বা কেন্দ্রীয় ব্যাংক নতুন কোনো নির্দেশনা জারি করলে পুরোনো কাঠামো সাময়িকভাবে স্থগিত করা হয়ে থাকে।
গ্রাহকদের প্রতি ব্যাংকের বার্তা
অগ্রণী ব্যাংক জানিয়েছে, “এজেন্ট ব্যাংকিং গ্রাহকদের সাময়িক অসুবিধার জন্য দুঃখ প্রকাশ করা হচ্ছে।” তবে গ্রাহক স্বার্থে দ্রুত পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটানো হবে কি না বা কখন এজেন্ট পয়েন্টগুলো পুনরায় চালু হবে— সে সম্পর্কে কোনো আভাস দেয়নি ব্যাংক।
নিয়ন্ত্রক সংস্থার নিরবতা
বাংলাদেশ ব্যাংক এই মুহূর্তে এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি। তবে একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের বিশাল পরিসরের সেবা হঠাৎ করে বন্ধ হয়ে যাওয়া স্বাভাবিকভাবে নিয়ন্ত্রক সংস্থার নজরে আসার কথা। বিশেষজ্ঞদের মতে, এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন অথবা অবহিতকরণ প্রয়োজন।
ভোক্তা অধিকার সংগঠন ও বিশ্লেষকদের প্রতিক্রিয়া
বাংলাদেশ ব্যাংকিং গবেষণা ফোরামের নির্বাহী পরিচালক ড. রায়হান মাহমুদ বলেন, “এজেন্ট ব্যাংকিং এমন এক প্ল্যাটফর্ম, যা গ্রামীণ ও সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই সেবা বন্ধ করে দেওয়ার আগে ব্যাংক কর্তৃপক্ষের উচিত ছিল বিকল্প ব্যবস্থা বা সময়সীমা ঘোষণা করা।”
ভোক্তা অধিকার বিষয়ক সংগঠনগুলোও মনে করছে, হঠাৎ করে এমন গুরুত্বপূর্ণ সেবা বন্ধ করায় গ্রাহকদের ভোগান্তি বাড়বে এবং ব্যাংকের ওপর আস্থা কমতে পারে।
উপসংহার
বর্তমান অর্থনৈতিক বাস্তবতায় যেখানে ডিজিটাল এবং বিকেন্দ্রীকৃত ব্যাংকিং সেবা সম্প্রসারণের জন্য সরকার ও ব্যাংকসমূহ নানা পদক্ষেপ নিচ্ছে, সেখানে অগ্রণী ব্যাংকের এজেন্ট ব্যাংকিং সেবা বন্ধ হয়ে যাওয়া দুঃখজনক ও প্রশ্নবিদ্ধ।
যদিও এটি সাময়িক ব্যবস্থা হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে, তবু এর প্রভাব দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে—বিশেষ করে যাদের ব্যাংকিং সুবিধা পাওয়ার প্রধান মাধ্যম ছিল এজেন্ট পয়েন্ট।
সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উচিত দ্রুততম সময়ে বিষয়টি স্বচ্ছভাবে ব্যাখ্যা করা এবং বিকল্প বা পুনরায় চালুর রূপরেখা প্রকাশ করা, যাতে গ্রাহকদের ভোগান্তি কমানো যায় এবং আস্থা পুনরুদ্ধার সম্ভব হয়।