বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি, বাংলাদেশে আমদানি ব্যয় বাড়ার আশঙ্কা

২০২৫ সালের জুন মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে মধ্যপ্রাচ্যের ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে তীব্র রাজনৈতিক ও সামরিক সংঘাত শুরু হওয়ার প্রভাবে বিশ্বজুড়ে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষজ্ঞ ও জ্বালানি আমদানিকারক সংস্থাগুলোর সতর্কবার্তা অনুযায়ী, সংঘাত দীর্ঘায়িত হলে তেলের মূল্য আরো বেড়ে যেতে পারে, যা সরাসরি বাংলাদেশের আমদানি খরচ ও জ্বালানি সরবরাহে প্রভাব ফেলবে।
বাংলাদেশের একমাত্র সরকারি জ্বালানি আমদানিকারক সংস্থা বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) ইতিমধ্যেই বিশ্ববাজারের এই পরিবর্তন মনিটর করছে এবং বিভিন্ন বিকল্প পরিকল্পনা গ্রহণে প্রস্তুতি নিচ্ছে। বিশেষত হরমুজ প্রণালির উপর নির্ভরশীলতা কমানোর প্রয়াস তীব্র হয়েছে, কারণ মধ্যপ্রাচ্যের এই গুরুত্বপূর্ণ নৌপথ বন্ধ হয়ে গেলে দেশের জ্বালানি আমদানি মারাত্মক ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে।
মধ্যপ্রাচ্যের অস্থিরতা ও হরমুজ প্রণালির গুরুত্ব
হরমুজ প্রণালি বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তেল পরিবহন নৌপথগুলোর একটি। গোটা বিশ্ববাজারের অপরিশোধিত তেলের প্রায় ২০ থেকে ৩০ শতাংশ এই পথ দিয়ে পরিবহন হয়। বিশেষত ইরান, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে বাংলাদেশে অপরিশোধিত তেল আমদানির ক্ষেত্রে এটি অপরিহার্য।
বিপিসির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বর্তমানে পরিশোধিত জ্বালানি তেলের প্রায় ২০% এবং অপরিশোধিত তেলের ৩০% হরমুজ প্রণালি দিয়ে আমদানি করা হয়। যদি এই নৌপথ বন্ধ হয়ে যায়, তবে বিকল্প রুট খুঁজতে হবে, যা আমদানি খরচ অনেক বাড়িয়ে দেবে।
বাংলাদেশে জ্বালানি তেলের বাজার পরিস্থিতি ও প্রস্তুতি
বাংলাদেশে দু’প্রকার জ্বালানি তেল আমদানি করা হয়—পরিশোধিত এবং অপরিশোধিত। দেশের একমাত্র তেল শোধনাগার বছরে সর্বোচ্চ ১৫ লাখ টন অপরিশোধিত তেল শোধন করতে সক্ষম। বাকিটা আমদানি নির্ভর।
বিপিসির শাখা সূত্র বলছে, অপরিশোধিত তেল প্রধানত সৌদি আরব থেকে ‘অ্যারাবিয়ান লাইট’ এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে ‘মারবান লাইট’ নামে আসে। তবে এসব তেলও হরমুজ প্রণালির মাধ্যমেই জাহাজে পরিবহন করা হয়।
বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ৬০ থেকে ৬৫ লাখ টন পরিশোধিত জ্বালানি তেল বিক্রি হয়। ডিজেল দেশের সবচেয়ে বেশি ব্যবহারকৃত জ্বালানি, যার ৪৬ লাখ টন আমদানির প্রয়োজন হয়, শুধু ৬ লাখ টন দেশেই উৎপাদিত হয়।
বিপিসির চেয়ারম্যান আমিন উল আহসান বলেছেন, বিশ্ববাজারে দাম বেড়েছে, তবে এখনো সরাসরি বাংলাদেশের ভোক্তা পর্যায়ে তেমন কোনো প্রভাব পড়েনি। তবে যুদ্ধ চলতে থাকলে আমদানি খরচ বেড়ে যেতে পারে এবং বিকল্প উৎস খোঁজার প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করা হয়েছে।
অর্থনৈতিক প্রভাব ও সরকারী মনোভাব
অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, “আমরা এই সংঘাতের প্রভাব মনিটর করছি। পরিস্থিতি আরো খারাপ হলে আমাদের ওপর প্রভাব পড়তে পারে, কিন্তু এখনই দাম বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি।”
বিশ্ববাজারে তেলের দাম বাড়লে দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দামও বাড়ার সম্ভাবনা থাকে। ২০১৬ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ডিজেলের দাম ছিল ৬৫ থেকে ৮০ টাকা লিটারে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে ২০২২ সালে ডিজেলের দাম ১১৪ টাকা পর্যন্ত ওঠে, পরে কিছুটা কমিয়ে ১০২ টাকা লিটারে স্থিতিশীল করা হয়েছে।
সরকার গত বছরের মার্চ থেকে জ্বালানি তেলের মূল্য স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিশ্ববাজারের দামের সাথে সামঞ্জস্য রেখে নির্ধারণ করছে। ফলে প্রতি মাসে নতুন দাম ঘোষণা করা হয়।
বিশ্ববাজারের জ্বালানি তেলের গতিপ্রকৃতি
২০২০ সালের ব্রেন্ট ক্রুড অয়েলের গড় দাম ছিল প্রায় ৪২ ডলার প্রতি ব্যারেল। ২০২১ সালে তা বেড়ে প্রায় ৭১ ডলার হয়। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে ২০২২ সালে সর্বোচ্চ ১৩৯ ডলার পর্যন্ত ওঠে। পরে কমে ৮০ ডলারের আশপাশে অবস্থান নেয়। ২০২৪ সালে গড় দাম ছিল ৭০ ডলার প্রতি ব্যারেল।
২০২৫ সালের এপ্রিল মাসে যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কারোপের পরে দাম ৬০ ডলারের নিচে নেমে আসে, কিন্তু ইরান-ইসরায়েল সংঘাত শুরু হওয়ার পর তা আবার ৭৫ ডলারে উঠেছে। বিশেষজ্ঞদের পূর্বাভাস, হরমুজ প্রণালি বন্ধ হলে দাম ১২০ ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে, যা বিশ্ব অর্থনীতির ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলবে
সম্ভাব্য বিকল্প উৎস ও করণীয়
বিপিসি ইতিমধ্যে ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া এবং আশেপাশের অন্যান্য দেশগুলোর সঙ্গে বিকল্প উৎস হিসেবে তেল আমদানির সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করছে। বিশেষ করে হরমুজ প্রণালি বন্ধ হলে সরবরাহে বিঘ্ন না ঘটাতে বিকল্প পথে আমদানি জরুরি।
দেশের তেলের মজুত ও সরবরাহ সুষ্ঠু রাখতে বিকল্প পরিকল্পনা গ্রহণের পাশাপাশি, মূল্যস্ফীতির প্রভাব কমানোর চেষ্টা সরকার করছে। বিপিসির চেয়ারম্যান বলেন, “আমরা ভোক্তা পর্যায়ে দাম বৃদ্ধির প্রভাব পুরোপুরি চাপিয়ে না দিয়ে পরিস্থিতি সামলানোর চেষ্টা করব।”
সামগ্রিক প্রভাব ও ভবিষ্যত ভাবনা
বিশ্বজুড়ে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে গেলে বাংলাদেশের অর্থনীতি প্রভাবিত হবে। আমদানি খরচ বাড়লে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যও বৃদ্ধি পেতে বাধ্য। যা সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
সুতরাং, সময়োপযোগী ব্যবস্থা গ্রহণ, বিকল্প উৎস ও পথ সন্ধান এবং দেশের অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বৃদ্ধি করা জরুরি। সরকারের উচিত এ ক্ষেত্রে সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণ করে দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।