বানিজ্য

‘চামড়ার ব্যবসাটা এখন চীনের হাতে, আর আমরা হয়ে গেছি তাদের কর্মচারী’

বাংলাদেশের চামড়া শিল্প এক কঠিন সংকটের মুখোমুখি। চামড়া রপ্তানি ও প্রক্রিয়াজাতকরণে দেশীয় ব্যবসায়ীরা এখন প্রায় ‘কর্মচারী’ অবস্থায়। মূল নিয়ন্ত্রণ চলে গেছে চীনা ব্যবসায়ীদের হাতে। বাংলাদেশে উৎপাদিত কাঁচা চামড়া রপ্তানিতে এককভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে চীনের বাজারের ওপর। এর ফলে দেশীয় ট্যানারি মালিক ও চামড়া ব্যবসায়ীরা ন্যায্য মূল্য পাচ্ছেন না এবং বাজার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে।

পশম ছাড়ানো থেকে প্রক্রিয়াজাতকরণ: চামড়ার দীর্ঘ পথ

সাভারের মদিনা ট্যানারিতে গত বৃহস্পতিবার দেখা যায়, পশুর কাঁচা চামড়া বিশাল ড্রামে ২৪ ঘণ্টা লবণযুক্ত পানিতে ভিজিয়ে রাখা হয়, যাতে পশম ঝড়ে যায়। এরপর একাধিক ধাপে এই চামড়াকে ওয়েটব্লু চামড়া হিসেবে প্রস্তুত করা হয়, যা রপ্তানি বা দেশীয় ব্যবহারের জন্য উপযুক্ত।

তবে এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেও ট্যানারি মালিকরা মূল্য সংক্রান্ত অনেক সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন। তারা জানান, চামড়ার দাম খুব কম, বাজার সংকুচিত এবং চামড়া রপ্তানির জন্য নতুন বাজার তৈরি না হওয়ায় উন্নতির কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না।

চীনের একচেটিয়া দখল

বাংলাদেশের কাঁচা চামড়া রপ্তানির একমাত্র প্রধান ক্রেতা এখন চীন। এর ফলে রপ্তানির দাম প্রভাবিত হচ্ছে। ব্যবসায়ীরা জানাচ্ছেন, চীনা ক্রেতারা প্রতি বর্গফুট চামড়া ৫০ থেকে ৬০ সেন্টে নিচ্ছে, মাঝে মাঝে দাম নেমে যায় ৪০ থেকে ৪৫ সেন্টেও। দেশীয় মুদ্রায় এটি প্রায় ৬০ থেকে ৭০ টাকা। অথচ সরকার ঢাকায় লবণযুক্ত চামড়ার দাম নির্ধারণ করেছে ৬০ থেকে ৬৫ টাকা, যা বাজারের বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।

মদিনা ট্যানারির স্বত্বাধিকারী রিয়াদ হোসেন বলেন, “আমরা চামড়া কিনতে চাইছিলাম ১০ হাজার পিস, কিনেছি তার অর্ধেক। প্রতিটি চামড়ার গড় দাম পড়েছে ৭০০ টাকা, কিন্তু লবণযুক্ত চামড়া কিনতে হচ্ছে ৯০০ থেকে ১১০০ টাকায়। আর চীনে বিক্রির দাম মাত্র ৩৫ থেকে ৪০ সেন্ট প্রতি বর্গফুট। এখন ব্যবসাটা পুরোপুরি চীনের হাতে, আমরা তাদের কর্মচারী হয়ে গেছি।”

বাজার সংকট ও দাম নির্ধারণে অসঙ্গতি

সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ঢাকায় গরুর লবণযুক্ত চামড়ার দাম প্রতি বর্গফুট ৬০-৬৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। সাধারণত মাঝারি আকারের গরুর চামড়া ২১ থেকে ৩০ বর্গফুটের হয়। এর মানে, মাঝারি গরুর চামড়ার দাম হবে প্রায় ১৫০০ থেকে ১৬২৫ টাকা। কিন্তু ব্যবসায়ীরা জানাচ্ছেন, এ দামে রপ্তানি সম্ভব নয়।

ট্যানারি মালিকদের মতে, ইউরোপের বাজার চালু হলে দাম বাড়বে। কিন্তু বাংলাদেশের চামড়া শিল্প এক দশক ধরে ইউরোপীয় পরিবেশগত মানদণ্ডের সনদ (এলডব্লিউজি) না পাওয়ায় বিশ্ববাজার থেকে প্রায় ছিটকে পড়েছে। এক সময় ইতালি, আমেরিকা ও কোরিয়ার ক্রেতারা বাংলাদেশ থেকে চামড়া কিনতেও, এখন তারা চীনের দিকে ঝুঁকে পড়েছে।

চীনা ব্যবসায়ীদের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ

সাভারের বিসিক চামড়াশিল্প নগরের চুক্তিভিত্তিক ব্যবসায়ী শামীম জানালেন, “চীনা ব্যবসায়ীরা একত্র হয়ে দাম ঠিক করে দেন। তারা একে অপরকে বলেন, আমরা ৪০ সেন্ট বলেছি, কেউ এর বেশি দাম বলবে না। তাদের এজেন্টরা এখানে ব্যবসার পরিবেশ নষ্ট করছে।”

এক ব্যবসায়ী আরও বলেন, লবণযুক্ত চামড়া কেনার পর পশমমুক্ত করা, শুকানো ও রং করার খরচ অন্তত ৭০ টাকা। সব মিলিয়ে তারা ৫০ সেন্ট দরে বিক্রি করলেও লাভের সুযোগ নেই। তিনি বলেন, সরকারকে কৃত্রিম চামড়া আমদানিতে শুল্ক বৃদ্ধি করার পরামর্শ দেওয়া উচিত। কারণ দেশের অনেক জুতা প্রস্তুতকারক ইউরোপ থেকেও চামড়া আমদানি করে।

সরকারী উদ্যোগ ও বাস্তবতা

সরকার চামড়া সংরক্ষণের জন্য বিনামূল্যে ৩০ হাজার টন লবণ বিতরণ করেছে। এটি বড় বড় এতিমখানা ও লিল্লাহ বোর্ডিংয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন অভিযোগ করেছেন, কেউ কেউ বিনামূল্যে পাওয়া লবণ বাজারে বিক্রি করছেন। ট্যানারিমালিকরাও একই অভিযোগ করেছেন।

ট্যানারি ব্যবসায়ী হাসান বলেন, “লবণ ব্যবহার ও সংরক্ষণের সঠিক প্রশিক্ষণ না দিলে চামড়া পচে যায়। বর্জ্য ব্যবস্থাপনা উন্নত না হলে ইউরোপের বাজার পাওয়াও কঠিন হবে। বিসিকের কাজ যথেষ্ট নয়, দায়িত্ব বেপজা বা শিল্প মন্ত্রণালয়ের হাতে দেওয়া উচিত।”

সংকটগ্রস্ত বিসিক চামড়াশিল্প নগর

সাভারের বিসিক চামড়াশিল্প নগরে মোট ২০৫টি বাণিজ্যিক প্লট রয়েছে, অনুমোদিত ট্যানারি সংখ্যা ১৬২, বর্তমানে চালু রয়েছে ১৪২টি। তবে সব ট্যানারি নিজস্বভাবে চামড়া প্রক্রিয়াজাত করে না, অনেকেই চুক্তিভিত্তিক ব্যবসা করেন। বাজার সংকুচিত হওয়ায় অনেক ব্যবসায়ী আগ্রহ হারাচ্ছেন, পুরনো প্রতিষ্ঠানগুলো ঝিমিয়ে পড়ছে এবং নতুন প্রজন্ম এ ব্যবসায় আসছে না।

মোহাম্মদ মেহরাজুল মাঈয়ান, নির্বাহী প্রকৌশলী, বিসিক চামড়াশিল্প নগর, বলেন, “আমরা দাম নির্ধারণ করি না, এটা শিল্প মন্ত্রণালয়ের কাজ। এ পর্যন্ত ৪ লাখ ১০ হাজার চামড়া আমাদের এখানে এসেছে, কিছু দিনের মধ্যে তা ৫ লাখ ছাড়াবে।”

ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা

বাংলাদেশের চামড়া শিল্পে ইউরোপীয় পরিবেশগত মানদণ্ড মেনে চলার গুরুত্ব দিন দিন বাড়ছে। এলডব্লিউজির সনদ না থাকায় বিশ্ববাজার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া ব্যবসায়ীদের জন্য এটি বড় বাঁধা। চীনা ব্যবসায়ীদের আধিপত্য কমাতে ও ইউরোপীয় বাজার পুনরায় জয় করতে হলে সরকারের কঠোর নীতি ও উদ্যোগ প্রয়োজন।

চামড়া শিল্পের উন্নতির জন্য:

  • বাজার বৈচিত্র্য বৃদ্ধি: শুধু চীনের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে নতুন বাজার তৈরি করতে হবে, বিশেষ করে ইউরোপ ও আমেরিকা।
  • পরিবেশবান্ধব প্রক্রিয়াজাতকরণ: বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় উন্নতি ও পরিবেশগত মান নিশ্চিত করা।
  • টেকসই দাম নির্ধারণ: স্থানীয় ব্যবসায়ীদের জন্য বাস্তবসম্মত ও ন্যায্য দাম নির্ধারণ।
  • প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তি উন্নয়ন: চামড়া সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণে আধুনিক প্রযুক্তি ও দক্ষতা বৃদ্ধির ব্যবস্থা।

বাংলাদেশের চামড়া শিল্পের ‘সোনালি দিন’ ফিরে আনার জন্য এসব পদক্ষেপ জরুরি। স্থানীয় ব্যবসায়ীদের স্বপ্ন ও দেশের অর্থনীতির জন্য চামড়া শিল্পের উন্নয়ন অপরিহার্য। বর্তমানে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে না আসলে, ভবিষ্যতে শিল্পের অস্তিত্ব সংকটে পড়বে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button