গাইবান্ধার ক্ষুদ্র চামড়া ব্যবসায়ীদের দামে হতাশা, বাড়তি খরচে জর্জরিত ব্যবসা

গাইবান্ধার ক্ষুদ্র চামড়া ব্যবসায়ীরা এই ঈদুল আজহায় চামড়া কেনাবেচায় বিপাকে পড়েছেন। মূল কারণ, বাজারে চামড়া কেনাবেচার মূল্যমানের অনিশ্চয়তা এবং সরকার নির্ধারিত মূল্যের তুলনায় বেশি দামে চামড়া কেনার চাপ। ফলে তাদের কাছে জটিলতা তৈরি হচ্ছে আর ব্যবসায় লোকসান হওয়ার আশঙ্কাও বাড়ছে।
পলাশবাড়ীর ঐতিহ্যবাহী চামড়া হাটে ব্যবসায়ীদের চোখ এখন
গাইবান্ধার কামারপাড়া গ্রামের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ভেলু রবিদাস (৫৬) প্রায় চার দশক ধরে এই ব্যবসায় জড়িত। তিনি বর্তমানে ২২৫টি গরু ও ১৩০টি ছাগলের চামড়া কিনে সংরক্ষণ করেছেন। গরুর চামড়া তিনি গড়ে ৯০০ টাকা ও ছাগলের ২৫০ টাকা দরে কিনেছেন। তবে সংরক্ষণ ও লবণ প্রক্রিয়ায় আরও যথাক্রমে ২০০ ও ১০০ টাকা খরচ পড়েছে, যার ফলে গরুর চামড়ার মোট খরচ দাঁড়িয়েছে ১,১০০ টাকা এবং ছাগলের ৩৫০ টাকা।
তবে বাজারের সঠিক মূল্য না পাওয়া এবং পাইকারদের কম দাম দেওয়ার কারণে তিনি চিন্তিত। ভেলু রবিদাস বলেন,
“দেনা করে বেশি দামে চামড়া কিনেছি, এখন বেচার বাজারে কম দাম পাচ্ছি। পাইকাররা কম দাম দিতে চায়, আর কম দামে বিক্রি করলে লোকসান। পলাশবাড়ীর হাটে ভালো দাম পাওয়ার আশায় আছি, সেখানে বাণিজ্য উপদেষ্টা আসবেন, আশা করি ভালো সমাধান হবে।”
প্রতিবছর ঈদের পর পলাশবাড়ী উপজেলায় প্রথম বুধবারে বসে এই ঐতিহ্যবাহী পশুর চামড়ার হাট। এখানে গাইবান্ধাসহ উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলা থেকে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা আসেন চামড়া বিক্রি করতে। ঢাকার ট্যানারির মালিকরা সরাসরি প্রতিনিধিদের মাধ্যমে এখানে চামড়া কেনেন এবং ট্রাকে পরিবহন করে নিয়ে যান।
বাজারের বাস্তবতা: বেশি খরচে কেনা চামড়া বিক্রি করতে পারছেন না ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা
গাইবান্ধার চামড়া ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করেন,
“বাজারে চামড়া প্রচুর, তবে ক্রেতার সংখ্যা কম। সরকার নির্ধারিত দাম ঢাকার বাইরে গরুর চামড়ার জন্য প্রতি বর্গফুট ৫০ থেকে ৫৫ টাকা, আর ছাগলের জন্য ১৭ থেকে ২০ টাকা হলেও, ব্যবসায়ীরা গ্রামের বাজার থেকে ৬০ থেকে ৬৫ টাকা ও ২২ থেকে ২৫ টাকা দরে কিনছেন। কিন্তু ট্যানারির মালিকরা সরকার নির্ধারিত দামে চামড়া কেনেন, বেশি দামে কেনা চামড়া বিক্রি করা কঠিন।”
এর ফলে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের উপর বেশি বোঝা পড়ে এবং তাদের অনেকেই ধারদেনা করে ব্যবসা পরিচালনা করলেও এখন চামড়া বিক্রি করতে না পারায় বিপাকে পড়েছেন।
গাইবান্ধার ব্রিজ রোডের একটি চামড়া আড়তের মালিক আরশাদ আলী জানান,
“আমি কিছু চামড়া কিনে সংরক্ষণ করেছি। যাদের বেশি দামে চামড়া কিনেছি, তাদের কাছ থেকে আবার সেই দামে কিনতে পারছি না। এখন সবার দৃষ্টি আগামী বুধবারের পলাশবাড়ীর হাটের দিকে।”
লাম্পি স্কিন রোগের প্রভাব: ব্যবসায় ঝামেলা বাড়ল
চামড়া ব্যবসায়ীদের আরেকটি বড় সমস্যা হলো গরুতে লাম্পি স্কিন রোগের বিস্তার। এই রোগে আক্রান্ত গরু অনেকেই ঈদের আগে বিক্রি করেছেন, যার কারণে ওই গরুগুলোর চামড়া ব্যবসায়ীদের কাছে এসেছে। কিন্তু অনেক ব্যবসায়ী অসাবধানতাবশত আক্রান্ত গরুর চামড়া কিনে বিপদে পড়েছেন। কারণ, রোগগ্রস্ত চামড়ার চাহিদা কম এবং দামও কমে যাচ্ছে।
সরকারি তদারকি ও বাণিজ্য উপদেষ্টার আশা
পলাশবাড়ী উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নাজমুল আলম জানান,
“আগামী বুধবার বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন এখানে আসবেন। তিনি চামড়া সংরক্ষণাগার পরিদর্শন করবেন এবং ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনা করবেন। আশা করছি, চামড়া ব্যবসায়ীদের বর্তমান সমস্যাগুলো সমাধানে তারা কার্যকর উদ্যোগ নেবেন।”
পলাশবাড়ী চামড়া ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবুল কালাম আজাদ বলেন,
“ঢাকা থেকে ট্যানারির মালিকেরা প্রতি বছর হাটে এসে চামড়া কেনেন। তাদের চাহিদার ওপর পুরো চামড়া বাজার নির্ভর করে। এই বছরের বাজার পরিস্থিতি অন্যান্য বছরের তুলনায় ভিন্ন হওয়ায় ব্যবসায়ীরা উদ্বিগ্ন।”
চামড়া ব্যবসায় সংকট: সমাধানের প্রয়োজনীয়তা
গাইবান্ধার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা বর্তমানে চামড়া কেনাবেচায় সংকটের মুখে পড়েছেন। ক্রয়মূল্যের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি ও বাজারে চাহিদার কমি ব্যবসায়িক ঝুঁকি বাড়িয়েছে। এছাড়া লাম্পি স্কিন রোগের কারণে গরুর চামড়ার মান ও দাম কমে যাওয়া তাদের ব্যবসার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
সরকার নির্ধারিত মূল্য ও বাজারের বাস্তবতার মধ্যকার ফারাক, পাইকার ও ট্যানারিদের মধ্যে দূরত্ব, এবং পর্যাপ্ত তদারকির অভাবে এই সমস্যাগুলো তৈরি হয়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। তাই ব্যবসায়ীদের সমস্যা সমাধানে সরকারি পক্ষের সক্রিয় হস্তক্ষেপ প্রয়োজন।
ব্যবসায়ীদের প্রত্যাশা
বাণিজ্য উপদেষ্টা ও অন্যান্য সরকারি কর্মকর্তাদের প্রতি চামড়া ব্যবসায়ীদের আশা,
- সরকার নির্ধারিত মূল্য বাস্তবায়ন ও পর্যাপ্ত ক্রেতা সরবরাহ নিশ্চিত করা,
- লাম্পি স্কিন রোগ প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ,
- ব্যবসায়ীদের ঋণ সমস্যায় সহজ সমাধান ও স্বল্প সুদে আর্থিক সহায়তা প্রদান,
- বাজারে স্বচ্ছতা ও জালিয়াতি রোধে কঠোর নজরদারি।
এই উদ্যোগগুলো নিলে গাইবান্ধা ও উত্তরবঙ্গের চামড়া ব্যবসায়ীরা স্বস্তি পাবেন এবং তাদের ব্যবসার ধারা পুনরুদ্ধার হবে।