চীনের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি করা ‘অত্যন্ত কঠিন’: ট্রাম্পের মন্তব্যে বিশ্ববাজারে নতুন অনিশ্চয়তা

বিশ্ব অর্থনীতির দুই প্রধান শক্তি যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে চলমান বাণিজ্য উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে নতুন করে উত্তাপ ছড়ালেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি সরাসরি বলেছেন, চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি করা “অত্যন্ত কঠিন”। বুধবার (৪ জুন) তিনি এ মন্তব্য করেন নিজ মালিকানাধীন সামাজিক মাধ্যম ‘ট্রুথ সোশ্যাল’-এ একটি পোস্টে।
ট্রাম্পের এমন বক্তব্য এমন সময় এলো, যখন তার প্রশাসন ইস্পাত ও অ্যালুমিনিয়ামের ওপর দ্বিগুণ হারে শুল্ক আরোপ করেছে, যা ইতিমধ্যে বিশ্ববাজারে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। একইসঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য আলোচনা সামান্য অগ্রগতির দিকে গেলেও, চীনের সঙ্গে সম্পর্ক আরও জটিল হয়ে উঠছে।
ট্রাম্পের বার্তা: সি চিন পিং ‘কঠিন মানুষ’, চুক্তি কঠিন
ট্রাম্প বলেন, “আমি চীনের প্রেসিডেন্ট সি-কে পছন্দ করি, সব সময় করেছি, ভবিষ্যতেও করব। কিন্তু তিনি অত্যন্ত কঠিন মানুষ। তাঁর সঙ্গে চুক্তি করা সত্যিই খুব কঠিন!” — এই ভাষায় চীন-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্য আলোচনার বাস্তবতাকে তুলে ধরেন তিনি।
এমন মন্তব্যে স্পষ্ট হয় যে, ট্রাম্প প্রশাসন চীনের প্রতি একদিকে কঠোর অবস্থান নিচ্ছে, অন্যদিকে সরাসরি সম্পর্কোন্নয়নের সম্ভাবনা ক্ষীণ হচ্ছে।
শুল্ক দ্বিগুণ: বিশ্ববাণিজ্যে টানাপড়েন
গত এপ্রিলে ট্রাম্প প্রশাসন চীনা পণ্যের ওপর সর্বোচ্চ ১৪৫ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক আরোপ করে। এর জবাবে চীনও যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করা পণ্যের ওপর ১২৫ শতাংশ পর্যন্ত পাল্টা শুল্ক দেয়। মে মাসে উভয়পক্ষ সাময়িকভাবে উত্তেজনা প্রশমনের ইঙ্গিত দিলেও তা স্থায়ী হয়নি।
সবশেষে, ২৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৫০ শতাংশ ইস্পাত ও অ্যালুমিনিয়ামের ওপর শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেন ট্রাম্প। এর কয়েক ঘণ্টা পরেই আসে তার ট্রুথ সোশ্যাল পোস্ট।
বিশ্লেষকদের মতে, এই নতুন শুল্কনীতি ইউরোপ, এশিয়া ও দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলোতে রপ্তানি নির্ভরশীল খাতগুলোতে চাপ তৈরি করবে। তবে যুক্তরাজ্যকে এই অতিরিক্ত শুল্ক থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে, যা ওয়াশিংটন-লন্ডনের বিশেষ কূটনৈতিক সম্পর্কের ইঙ্গিত দেয়।
চীনের প্রতিক্রিয়া: ‘নীতিগত অবস্থান অপরিবর্তিত’
চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র লিন জিয়ান নিয়মিত ব্রিফিংয়ে ট্রাম্পের মন্তব্যের জবাবে বলেন, “চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক উন্নয়নে চীনের নীতিগত অবস্থান অপরিবর্তিত রয়েছে।”
এ বক্তব্যে স্পষ্ট যে, বেইজিং উত্তেজনা আরও না বাড়িয়ে কৌশলগত ধৈর্য দেখাতে চায়। তবে শুল্ক ও বাণিজ্যসংক্রান্ত পারস্পরিক জবাবি পদক্ষেপে দুই পক্ষের মধ্যে আস্থার ঘাটতি প্রকট।
বাণিজ্য সংকটের প্রেক্ষাপটে ওইসিডি বৈঠক
ট্রাম্পের এই বাণিজ্য পদক্ষেপ নেওয়ার সময় ছিল অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও উন্নয়ন সংস্থার (OECD) বার্ষিক সম্মেলনের ঠিক আগমুহূর্তে। দুই দিনব্যাপী এই সম্মেলনে বিশ্ব নেতারা প্যারিসে জড়ো হয়েছেন এবং আলোচনা করছেন বাণিজ্য যুদ্ধের কারণে বৈশ্বিক বাজারে যে অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে তা নিয়ে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসী শুল্কনীতি ও একতরফা পদক্ষেপের ফলে বিশ্বব্যাপী রপ্তানি নির্ভরশীল দেশগুলো চাপে পড়েছে। এসব বৈঠকে ট্রাম্প প্রশাসনের একক সিদ্ধান্ত নীতির তীব্র সমালোচনা হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে আংশিক অগ্রগতি
চীনের সঙ্গে আলোচনা জটিল হয়ে উঠলেও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য আলোচনা কিছুটা এগিয়েছে বলে জানা গেছে। তবে উভয়পক্ষ এখনো অনেক বিষয়ে একমত হতে পারেনি, বিশেষ করে কৃষিপণ্য, তথ্যপ্রযুক্তি ও সবুজ জ্বালানিভিত্তিক বিনিয়োগ বিষয়ে।
বাণিজ্য বিশ্লেষকরা বলছেন, ইউরোপের সঙ্গে আলোচনায় অগ্রগতি ট্রাম্প প্রশাসনের কূটনৈতিক ভারসাম্য রক্ষায় সহায়ক হতে পারে, তবে চীনের সঙ্গে উত্তেজনা সমাধান না হলে বৈশ্বিক বাজারে নেতিবাচক প্রভাব অব্যাহত থাকবে।
বিশ্বব্যাপী সম্ভাব্য প্রভাব
বিশ্বের দুই বৃহত্তম অর্থনীতির মধ্যে সম্পর্কের অবনতি হলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যব্যবস্থা ও সরবরাহ চেইনের ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়ে। বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলো, যারা চীন বা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে গভীরভাবে ব্যবসায় জড়িত, তারাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হবে।
বিশ্বব্যাংক এবং আইএমএফ পূর্বেই হুঁশিয়ারি দিয়েছিল যে, দীর্ঘস্থায়ী বাণিজ্য যুদ্ধের ফলে বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি হ্রাস পেতে পারে এবং দারিদ্র্য বিমোচন কার্যক্রমে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রস্তুতি ও ‘চীন কার্ড’
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ২০২৪ সালের নির্বাচনে জয়লাভের পর দ্বিতীয় মেয়াদে ট্রাম্প ফের চীনকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করতে পারেন। ‘চীন কার্ড’ ব্যবহার করে তিনি দেশের অভ্যন্তরীণ ভোটারদের কাছে নিজেকে ‘জাতীয় স্বার্থ রক্ষাকারী নেতা’ হিসেবে তুলে ধরতে চাইছেন।
চীনের সঙ্গে কড়া অবস্থান নেওয়ার মাধ্যমে তিনি মার্কিন শিল্পখাতকে বিদেশি প্রতিযোগিতা থেকে রক্ষা করার প্রচার চালাচ্ছেন। তবে এই নীতি যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বাজারে পণ্যের দাম বাড়াতে পারে বলে অনেক অর্থনীতিবিদ সতর্ক করছেন।
ট্রাম্পের মন্তব্য এবং তার প্রশাসনের কঠোর বাণিজ্যনীতি শুধু চীন নয়, গোটা বিশ্ব অর্থনীতিকেই নতুন করে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলছে। শুল্ক-ভিত্তিক এই আগ্রাসী কৌশল দীর্ঘমেয়াদে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রদের সঙ্গেও দূরত্ব বাড়াতে পারে। বাণিজ্য আলোচনায় “কঠিন মানুষ” সি চিন পিংয়ের সঙ্গে আপস কতটা সম্ভব, সেটা সময়ই বলে দেবে। তবে এই মুহূর্তে বিশ্ববাজারে অনিশ্চয়তার মেঘ আরও ঘনীভূত হয়েছে।