ঈদের আগে গরমমসলার বাজারে ভাটা: দাম কমলেও নেই ক্রেতা

কোরবানির ঈদ সামনে। আর মাত্র দুই দিন বাকি। এই সময়টা সাধারণত বাজারে গরমমসলার চাহিদা সবচেয়ে বেশি থাকে। রান্নায় ব্যবহৃত এলাচি, দারুচিনি, লবঙ্গ, জিরা, ধনে, কাজুবাদাম, আদা, রসুন, পেঁয়াজের মতো পণ্যের দামও সাধারণত বাড়ে। কিন্তু এবার চিত্রটা ভিন্ন। ঢাকার মোহাম্মদপুর, টাউন হল বাজার, কারওয়ান বাজার এবং চট্টগ্রামের বহদ্দারহাট, খাতুনগঞ্জ বাজার ঘুরে দেখা গেছে—এবার মসলার বাজার কিছুটা ‘ঠান্ডা’।
দোকানিদের ভাষায়, “মাল আছে, মানুষ নেই”। বাজারে সরবরাহ পর্যাপ্ত হলেও ক্রেতা তুলনামূলক কম। ফলে দামও স্থির বা কিছু ক্ষেত্রে কম। শুধু এলাচি ও দারুচিনির মতো কয়েকটি মসলার দাম বেড়েছে। তবে অন্যসব মসলার দাম গত বছরের তুলনায় নিচেই আছে।
মসলা বাজারে দামের চিত্র
গতকাল বুধবার রাজধানীর কয়েকটি বাজার ঘুরে দেখা গেছে,
- এলাচি: প্রতি কেজি ৫০০০ থেকে ৫৫০০ টাকা (পাড়া-মহল্লায় ৫৫০০–৬২০০ টাকা পর্যন্ত)
- দারুচিনি: প্রতি কেজি ৪৫০–৫৫০ টাকা
- লবঙ্গ: প্রতি কেজি ১২০০–১৩০০ টাকা
- জিরা: প্রতি কেজি ৬০০–৭৫০ টাকা
- ধনে: প্রতি কেজি ১৮০–২২০ টাকা
- কাজুবাদাম: প্রতি কেজি ১২০০–১৫০০ টাকা
- আদা ও রসুন: দাম স্থিতিশীল (আদা ১৩০–১৫০ টাকা, দেশি রসুন ১৮০–২০০ টাকা)
চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ বাজারেও একই রকম দাম দেখা গেছে। খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন, এলাচি ও দারুচিনির দাম তুলনামূলক বেশি হলেও জিরা, ধনে, লবঙ্গের দাম কম।
এলাচির দাম এখন আকাশছোঁয়া
সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)‘র তথ্য অনুযায়ী, গত এক বছরে এলাচির দাম বেড়েছে প্রায় ৩৩ শতাংশ।
এর প্রধান কারণ হিসেবে দেখা যাচ্ছে—
- ডলারের উচ্চ দর
- আমদানির খরচ বৃদ্ধি
- আমদানির উপর শুল্ক বৃদ্ধি
- সরবরাহ সীমিত হওয়া
- গোপনপথে (চোরাইপথে) আসা এলাচির পরিমাণ কমে যাওয়া
বাংলাদেশ পাইকারি গরমমসলা ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মো. এনায়েত উল্লাহ বলেন,
“বাজারে এলাচির দাম বেশি, অথচ ক্রেতা কম। আমরা বাধ্য হয়ে কিছু পণ্য কম লাভে বিক্রি করছি। শুল্ক কমানো হলে দামও আরও কমবে।”
কেন ‘ঠান্ডা’ গরমমসলার বাজার?
ব্যবসায়ীদের মতে, এবার ঈদে গরমমসলার চাহিদা প্রত্যাশার তুলনায় কম। তারা বলছেন,
- সাধারণ জনগণের ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে।
- নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেশি হওয়ায় ঈদের জন্য অতিরিক্ত বাজার করতে পারছেন না অনেকে।
- দেশজুড়ে আয় অনিশ্চয়তা এবং কিছু ক্ষেত্রে ঋণের বোঝা থাকায় মানুষ সীমিত খরচে চলছেন।
- বড় আমদানিকারকের পরিবর্তে অনেক খুচরা ব্যবসায়ী মসলা আমদানি করছেন, ফলে বাজারে প্রতিযোগিতা বেড়েছে।
চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জের মসলা ব্যবসায়ী মহিউদ্দিন বলেন,
“পণ্য আছে প্রচুর, কিন্তু কেনার মতো ক্রেতা নেই। ফলে দামও আগের মতো চড়া নয়।”
আমদানি নির্ভরতা ও চ্যালেঞ্জ
বাংলাদেশে গরমমসলার বাজার অনেকটাই আমদানিনির্ভর। ভারত, মিয়ানমার, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া ও চীন থেকে বেশি মসলা আমদানি করা হয়।
তবে কিছু সমস্যার মুখোমুখি ব্যবসায়ীরা—
- ডলারের সংকট
- এলসি (ঋণপত্র) খোলা কঠিন
- শুল্ক বেড়ে যাওয়া
- চোরাপথ বন্ধ হয়ে যাওয়া
এর ফলে কেউ কেউ মসলা আমদানি করতে পারছেন না, আবার অনেকে আমদানি করেও দাম বেশি হওয়ায় বিক্রিতে সমস্যা পড়ছেন।
কীভাবে স্থিতিশীল রাখা যায় বাজার?
ব্যবসায়ীদের দাবি—
- সরকার যেন মসলার আমদানি শুল্ক কিছুটা কমায়
- ভর্তুকি ভিত্তিতে এলসি সুবিধা দেয়
- বাজার তদারকিতে আরও কঠোরতা আনে
- প্রয়োজনে টিসিবির মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে মসলা বাজারজাত করে
এনায়েত উল্লাহ বলেন,
“যদি শুল্ক কমে, ডলারের দামে স্থিতিশীলতা আসে, তাহলে মসলার দাম স্বাভাবিক হবে এবং ক্রেতাও বাড়বে।”
ঈদুল আজহা বাংলাদেশের অন্যতম বড় উৎসব। কোরবানির মাংস সংরক্ষণ ও রান্নার জন্য মসলা অপরিহার্য। তবে এবার দেখা যাচ্ছে, পণ্যের দাম কম হলেও বাজারে নেই তেমন ক্রেতা। সরবরাহ রয়েছে পর্যাপ্ত, তবে অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা ও উচ্চমূল্যের অন্যান্য খরচের কারণে সাধারণ মানুষ বেছে বেছে বাজার করছেন।
সরকার যদি সময়মতো আমদানি শুল্ক হ্রাস ও ডলারের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে, তবে মসলার বাজারে স্থিতিশীলতা আসবে এবং সাধারণ মানুষ স্বস্তি পাবে।