বাজেট ২০২৫-২৬ লেনদেন কর বাদ দেওয়া প্রয়োজন: এমসিসিআই

দেশের প্রভাবশালী ব্যবসায়িক সংগঠন মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি, ঢাকা (এমসিসিআই) মনে করে, কোম্পানির লেনদেনের ওপর ধার্য ন্যূনতম কর (টার্নওভার ট্যাক্স) কার্যকর করনীতির পরিপন্থী। প্রতিষ্ঠানটি বলেছে, লাভ হোক বা না হোক, শুধুমাত্র লেনদেনের ভিত্তিতে ১ শতাংশ হারে কর আরোপ করা ব্যবসাবান্ধব নয় এবং এটি বাদ দেওয়া উচিত।
২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটকে কেন্দ্র করে গণমাধ্যমে পাঠানো এক প্রতিক্রিয়ায় এমসিসিআই এসব অভিমত প্রকাশ করে। বাজেট উপস্থাপনের জন্য অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদকে অভিনন্দন জানালেও বাজেটের বেশ কিছু দিক নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে তারা।
ন্যূনতম কর নিয়ে আপত্তি
এমসিসিআইয়ের মতে, লাভজনক আয় ছাড়া কর আরোপের বিষয়টি ব্যবসার মৌলিক নীতিমালার পরিপন্থী। প্রতিষ্ঠানটি বলেছে, ‘লেনদেনের ওপর টার্নওভার কর ০.৬ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১ শতাংশ করায় কোম্পানিগুলোর ওপর অযথা চাপ সৃষ্টি হবে। বিশেষ করে যেসব কোম্পানি ক্ষতিতে রয়েছে, তারাও এই কর দিতে বাধ্য হবে।’ এই ব্যবস্থা ব্যবসার উৎসাহ কমিয়ে দেবে এবং নতুন বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত করবে বলেও মনে করে চেম্বারটি।
বিনিয়োগ পরিস্থিতি ও কর্মসংস্থানে উদ্বেগ
চলমান অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে বিনিয়োগ পরিস্থিতি নিয়ে এমসিসিআই গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তারা জানিয়েছে, ‘গত ১০ বছরের মধ্যে বিনিয়োগ বর্তমানে সবচেয়ে নিম্নপর্যায়ে। বিনিয়োগ স্থবিরতার কারণে কর্মসংস্থান হ্রাস পাচ্ছে এবং দরিদ্র জনগণের সংখ্যা বাড়ছে।’ চেম্বারটির ভাষ্যমতে, বিনিয়োগের এই স্থবিরতা জাতীয় অর্থনীতির ঝুঁকি বাড়িয়ে দিয়েছে।
আইএমএফের শর্ত ও বাজেট ঘাটতির আশঙ্কা
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সুপারিশ বাস্তবায়নে সরকার কর ব্যবস্থা সংস্কার করছে, যার ফলে বাজেট ঘাটতির সম্ভাবনা বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে এমসিসিআই। তারা বলেছে, কর-জিডিপি অনুপাত বাড়ানোর প্রয়াসে করদাতাদের ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে, যা অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
এই প্রেক্ষাপটে সরকারি প্রকল্পের ব্যয় সংকোচন এবং অপ্রয়োজনীয় খরচ হ্রাসে মনোযোগ দেওয়ার আহ্বান জানায় প্রতিষ্ঠানটি।
ব্যাংকিং খাত থেকে ঋণ এবং এর প্রভাব
২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে ব্যাংক খাত থেকে ১ লাখ ৪ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছে। এমসিসিআই বলছে, সরকারের এই ঋণ গ্রহণের ফলে বেসরকারি খাতের জন্য ঋণ প্রবাহ কমে যেতে পারে, যার ফলে বিনিয়োগ ব্যাহত হতে পারে এবং মূল্যস্ফীতির চাপ আরও বাড়তে পারে। এমসিসিআই এ ক্ষেত্রে ব্যাংক খাত পুনর্গঠনের জন্য বাজেটে নির্দিষ্ট বরাদ্দ রাখার আহ্বান জানায়।
সামাজিক নিরাপত্তা ও অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তা
চেম্বারটি মনে করে, বাজেটে গরিবমুখী ও অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া উচিত। তারা উল্লেখ করেছে, প্রস্তাবিত বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর জন্য ১ লাখ ১৬ হাজার ৭৩১ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হলেও এই বরাদ্দ চলতি অর্থবছরের তুলনায় প্রায় ১৯ হাজার ২৯৫ কোটি টাকা কম। এমন পরিস্থিতিতে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য সহায়তা বাড়ানো সময়ের দাবি।
কাঠামোগত বাধা ও রাজস্ব সমস্যা
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পথে প্রধান বাধা হিসেবে এমসিসিআই উল্লেখ করেছে অনুন্নত অবকাঠামো, দুর্বল যোগাযোগব্যবস্থা, জ্বালানির বৈষম্যমূলক বণ্টন এবং প্রশাসনিক জটিলতাকে। তারা বলেছে, ‘এসব বাধা ব্যবসার গতি কমিয়ে দিচ্ছে এবং উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করছে।’
এছাড়া, রাজস্ব আহরণ ব্যবস্থার দুর্বলতাকেও এমসিসিআই বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে উল্লেখ করে বলেছে, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) বাস্তবায়নের অক্ষমতাও জাতীয় অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
বৈদেশিক মুদ্রা ও সামষ্টিক স্থিতিশীলতা
বর্তমানে উচ্চ আমদানি নির্ভরতা এবং বৈশ্বিক অস্থিরতা বিবেচনায় বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয়ে সতর্কতা অবলম্বনের পরামর্শ দিয়েছে এমসিসিআই। তারা মনে করে, সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষা করতে হলে আমদানি নিয়ন্ত্রণ এবং রিজার্ভ ব্যবস্থাপনায় ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে।
আয়কর নীতিমালা ও করদাতার সংখ্যা
চেম্বারটি জানিয়েছে, দেশে বর্তমানে ১ কোটি ১৪ লাখ ইটিআইএনধারীর মধ্যে আয়কর রিটার্ন জমা দেন মাত্র ৪৫ লাখ। এর মধ্যে প্রায় দুই-তৃতীয়াংশই শূন্য রিটার্ন। এমসিসিআই মনে করে, কর ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা ও আধুনিকায়নের মাধ্যমে রাজস্ব আহরণ বাড়ানো সম্ভব।
তারা আরও বলেছে, প্রান্তিক করদাতাদের ন্যূনতম কর ৩ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫ হাজার টাকা করার প্রস্তাব তাদের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়াবে, যা করমুখিতা কমাতে পারে।
করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়ানোর দাবি
জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির বাস্তবতায় ব্যক্তি করদাতাদের করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়ানো উচিত বলে মনে করে এমসিসিআই। প্রস্তাবিত বাজেটে এই সীমা ৩ লাখ ৭৫ হাজার টাকা নির্ধারণ করা হলেও চেম্বারটির মতে, এটি সাড়ে ৪ লাখ টাকা পর্যন্ত বৃদ্ধি করা উচিত ছিল, যাতে নিম্ন আয়ের জনগণ কিছুটা স্বস্তি পায়।
উপসংহার
২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটকে স্বাগত জানালেও বাস্তব অর্থনীতির সংকট, বিনিয়োগ স্থবিরতা, কর ব্যবস্থার অসামঞ্জস্য এবং সামাজিক নিরাপত্তার ঘাটতিকে কেন্দ্র করে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ করেছে এমসিসিআই। তাদের মতে, এসব প্রস্তাব বিবেচনায় না নিলে বাজেট কাঙ্ক্ষিত অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে ব্যর্থ হতে পারে।