পণ্য রপ্তানি মে মাসে বেড়েছে সাড়ে ১১ শতাংশ

দেশের পণ্য রপ্তানি খাতে এক চমকপ্রদ উল্লম্ফন দেখা যাচ্ছে। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক চাপ, গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকট, যুক্তরাষ্ট্রের ট্রাম্প প্রশাসনের পাল্টা শুল্ক আরোপ—এই সব প্রতিবন্ধকতার মাঝেও বাংলাদেশের রপ্তানি ধারাবাহিকভাবে ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি অর্জন করে যাচ্ছে। সদ্য সমাপ্ত মে মাসে দেশের রপ্তানি আয় দাঁড়িয়েছে ৪৭৪ কোটি মার্কিন ডলারে, যা গত বছরের একই মাসের তুলনায় ১১ দশমিক ৪৫ শতাংশ বেশি।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) কর্তৃক মঙ্গলবার প্রকাশিত হালনাগাদ পরিসংখ্যানে উঠে আসে এই চিত্র। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুলাই থেকে মে—এই ১১ মাসে দেশের মোট পণ্য রপ্তানি আয় দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ৪৯৫ কোটি মার্কিন ডলারে, যা ২০২৩-২৪ অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ১০ শতাংশ বেশি।
চ্যালেঞ্জের মধ্যেও দৃঢ়তা
বিশ্ববাজারে মূল্যস্ফীতি, কাঁচামালের দাম বৃদ্ধি, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং জ্বালানি সংকটের মধ্যেও বাংলাদেশের রপ্তানি খাত দৃঢ়তার সঙ্গে এগিয়ে চলেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই প্রবৃদ্ধি প্রমাণ করে যে দেশের শিল্প খাত ক্রমাগত বৈচিত্র্যতা অর্জন করছে এবং নতুন বাজারে প্রবেশ করছে।
বাংলাদেশ তৈরি পোশাক খাতের মাধ্যমে বিশ্ববাজারে সুপরিচিত। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, হোম টেক্সটাইল, ইঞ্জিনিয়ারিং পণ্য, হিমায়িত খাদ্যপণ্য এবং প্লাস্টিক খাতেও রপ্তানি বেড়েছে।
তৈরি পোশাক খাতে নেতৃত্ব অব্যাহত
মে মাসে এককভাবে তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছে ৩৯২ কোটি ডলারের, যা গত বছরের মে মাসের তুলনায় ১১ দশমিক ৮৫ শতাংশ বেশি। অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে পোশাক রপ্তানির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৬৫৬ কোটি ডলারে—এই প্রবৃদ্ধির হার ১০ দশমিক ২০ শতাংশ।
বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ) বলছে, আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের আস্থা পুনঃস্থাপন, টেকসই উৎপাদন প্রক্রিয়া এবং নতুন বাজার অনুসন্ধানের মাধ্যমে এই সাফল্য এসেছে। তারা আরও বলছে, আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকার উদীয়মান বাজারে এখন নজর দেওয়া হচ্ছে, যেখানে প্রতিযোগিতা অপেক্ষাকৃত কম এবং চাহিদা বাড়ছে।
অন্যান্য খাতের উল্ল্যেখযোগ্য অগ্রগতি
ইপিবির তথ্যানুযায়ী, মে মাসে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, হোম টেক্সটাইল, পাট ও পাটজাত পণ্য, চামড়াবিহীন জুতা, হিমায়িত খাদ্য, প্লাস্টিক পণ্য এবং প্রকৌশল খাতের রপ্তানিতেও প্রবৃদ্ধি হয়েছে। বিশেষ করে প্লাস্টিক ও প্রকৌশল পণ্য রপ্তানিতে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যে ধারা লক্ষ্য করা যাচ্ছে, তা দেশীয় শিল্পের সক্ষমতা বৃদ্ধির ইঙ্গিত দেয়।
একই সঙ্গে, হিমায়িত চিংড়ি, মাছ ও অন্যান্য সামুদ্রিক খাদ্যপণ্যের চাহিদা ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যসহ কিছু বাজারে বেড়েছে। এই খাতে আধুনিক সংরক্ষণ প্রযুক্তি এবং আন্তর্জাতিক মান রক্ষা করার ফলে রপ্তানি আয়ে ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্য রপ্তানিতে ধস
একই সময়ে কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্য রপ্তানিতে কিছুটা ধস দেখা গেছে। সংশ্লিষ্ট খাতের ব্যবসায়ীদের মতে, উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি কিছু দেশে প্রবেশ শুল্ক ও নতুন খাদ্য সুরক্ষা মানদণ্ডের কারণে এই খাতে প্রবৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কৃষিপণ্য রপ্তানিতে টেকসই ও নিরাপদ খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বৈচিত্র্য আনতে হবে, তবেই এই খাত পুনরুজ্জীবিত হতে পারবে।
রপ্তানি বৃদ্ধির পেছনে নীতিগত সহায়তা
বিশ্লেষকরা মনে করেন, রপ্তানি বৃদ্ধির পেছনে সরকারের প্রণোদনা প্যাকেজ, রপ্তানি পণ্যে নগদ সহায়তা, এক্সপোর্ট ডেভেলপমেন্ট ফান্ড (ইডিএফ)-এর সহজ শর্তে ঋণ সুবিধা এবং এক্সপোর্ট-ফ্রেন্ডলি নীতিমালার অবদান রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকও রপ্তানি সংশ্লিষ্ট খাতে দ্রুত অর্থ ছাড়ের বিষয়ে ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে।
এছাড়া, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও কাস্টমস কর্তৃপক্ষের ডিজিটালাইজেশন উদ্যোগ এবং এক্সপোর্ট ক্লিয়ারেন্স প্রক্রিয়া সহজ করার ফলে রপ্তানিকারকদের মধ্যে আস্থা বাড়ছে।
ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ ও সুপারিশ
তবে বিশ্লেষকরা সতর্ক করে দিয়েছেন যে, সামনের দিনগুলোতে কিছু বড় চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। যেমন: বৈশ্বিক মুদ্রাস্ফীতি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের নতুন শুল্ক নীতিমালা, জ্বালানি সরবরাহে অনিশ্চয়তা এবং দক্ষিণ এশিয়ায় বর্ধিত প্রতিযোগিতা।
তারা পরামর্শ দিচ্ছেন, রপ্তানি বাজারে বৈচিত্র্য আনতে হবে, গবেষণা ও উদ্ভাবনে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে এবং উৎপাদন খরচ নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। একই সঙ্গে শ্রমিকদের দক্ষতা বৃদ্ধি ও প্রযুক্তিনির্ভর উৎপাদন ব্যবস্থার উন্নয়নের মাধ্যমেই টেকসই রপ্তানি প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করা সম্ভব।
উপসংহার
সব ধরনের বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও বাংলাদেশ যে রপ্তানি খাতে ইতিবাচক ধারায় রয়েছে, তা নিঃসন্দেহে আশার বাণী। এই ধারা ধরে রাখতে হলে শুধু পোশাক নয়, অন্যান্য সম্ভাবনাময় খাতগুলোকেও প্রণোদনা দিতে হবে এবং আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী প্রস্তুত করতে হবে। রপ্তানিতে বর্তমান সাফল্য ভবিষ্যতের প্রবৃদ্ধির মাইলফলক হয়ে উঠুক—এটাই এখন সময়ের দাবি।