জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান সম্প্রতি এক গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকের পর সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। তিনি স্পষ্টভাবে জানান, “আমরা ধর্মকে কখনো ব্যবহার করি না, ধর্ম আমাদের চিন্তা-কলিজার অংশ, এবং ধর্ম নিয়েই আমরা আমাদের কাজ করি।”
সোমবার দুপুরে ঢাকায় নিযুক্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) রাষ্ট্রদূতসহ অন্যান্য কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠক শেষে এই মন্তব্য করেন ডা. শফিকুর রহমান। বৈঠক শেষে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকরা ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার নিয়ে তার কাছে প্রশ্ন করলে তিনি এসব কথা বলেন।
ধর্ম ও রাজনীতি: জামায়াতের স্পষ্ট অবস্থান
ডা. শফিকুর রহমান বলেন, “ধর্মকে যারা ব্যবহার করে, তা সবাই জানেন। নির্বাচনের সময় যারা বেশি বেশি নামাজ পড়েন, টুপি পরেন, তসবিহ হাতে নিয়ে ঘোরেন—ধর্মকে তারাই ব্যবহার করেন। আমরা আমাদের কাজগুলো বিশ্বাসের আওতায় করতে চাই। ধর্মকে রাজনৈতিক কাজে ব্যবহার করা আমাদের নীতি নয়।”
তিনি আরও বলেন, দেশের রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার নিয়ে যে সমালোচনা হচ্ছে, তা দলের জন্য নয়, জনগণের জন্য রাজনীতি করার প্রতিশ্রুতির সঙ্গে কোনো সম্পর্ক রাখে না। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “আমরা ধর্মের নামে রাজনীতি করি না। আমাদের রাজনীতি জনগণের কল্যাণের জন্য।”
নির্বাচনের গুরুত্ব ও সময়সূচি
এক প্রশ্নের জবাবে জামায়াত আমির স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেন, “আমরা মনে করি নির্বাচনের পেছানো উচিত নয়। ফেব্রুয়ারিতে ঘোষিত সময়সূচি অনুযায়ী নির্বাচন হওয়া দেশের জন্য একান্ত প্রয়োজন। এর সামান্য কোনো ব্যত্যয় হলে দেশ দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।”
তিনি বলেন, “কারো দ্বারাই দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হোক, এটা আমরা চাই না। আমাদের লক্ষ্য দেশের স্থিতিশীলতা এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার সংহতি নিশ্চিত করা।”
ইইউ রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে বৈঠক
রাজধানীর গুলশানে ইইউ কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত বৈঠকে ডা. শফিকুর রহমানের সঙ্গে জামায়াতের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য মোবারক হোসাইনও উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি, নির্বাচন এবং দেশের সামাজিক-অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়।
বৈঠক শেষে জামায়াত আমির বলেন, “ইইউ রাষ্ট্রদূত এবং অন্যান্য কূটনীতিকরা মূলত বাংলাদেশের পরিবেশ ও পরিস্থিতি নিয়ে আমাদের কাছ থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানতে চেয়েছেন। আমরা তাদের জানিয়েছি, নির্বাচিত হলে আমরা একটি ইনক্লুসিভ বাংলাদেশ গড়ার চেষ্টা করব, যেখানে কোনো দল বা মানুষ বাদ থাকবে না।”
তিনি বলেন, আগামী পাঁচ বছরে দেশের স্থিতিশীলতা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং দুর্নীতি নির্মূলের জন্য জাতীয় সরকার গঠন অপরিহার্য। নির্বাচিত হলে জামায়াত সেই সরকার গঠন করবে।
নির্বাচনে দুর্নীতি ও সমান বিচার
ডা. শফিকুর রহমান আরও বলেন, নির্বাচনে যারা অংশগ্রহণ করবে, তাদের কাছে দুটি গুরুত্বপূর্ণ প্রত্যাশা থাকবে:
- দুর্নীতি করা থেকে বিরত থাকা এবং দুর্নীতিকে প্রশ্রয় না দেওয়া।
- সবার জন্য সমান বিচার নিশ্চিত করা, যাতে কেউ রাজনৈতিকভাবে হস্তক্ষেপ করতে না পারে।
তিনি স্পষ্ট করে বলেন, “এটি শুধু দলের জন্য নয়, দেশের জন্য। আমরা চাই দেশের স্বার্থে এই নীতিমালা মানা হোক, এবং আমাদের নির্বাচিত হলে সরকার গঠনেও এটি প্রতিফলিত হবে। এমনকি আমরা যদি ২০০ আসনেও বিজয়ী হই, ইনশাআল্লাহ আমরা এই নীতি বজায় রাখব।”
যুব সমাজ ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য আহবান
জামায়াত আমির দেশবাসী এবং বিশেষ করে যুব সমাজকে আহবান জানিয়ে বলেন, “অতীতে যা হয়েছে, তা অতীতেই সীমাবদ্ধ থাক। এখন আমাদের লক্ষ্য দেশের ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বার্থে কাজ করা। যুব সমাজের আকাঙ্ক্ষা যেন কোনোভাবে ব্যাহত বা আহত না হয়, সে ব্যাপারে আমরা দারুণ শ্রদ্ধাশীল।”
ইইউ কূটনীতিকদের জিজ্ঞাসা ও জামায়াতের প্রতিক্রিয়া
বৈঠকে কূটনীতিকরা জামায়াতকে জানেন, ফেব্রুয়ারির নির্বাচন ও সাধারণ নির্বাচন একই দিনে হলে কি কোনো সমস্যা হতে পারে। জামায়াতের প্রতিক্রিয়া ছিল:
- দেশের মানুষ এখনও ততটা সচেতন নয়।
- একই দিনে দুটি নির্বাচন হলে ভোটার টার্নওভার কম হতে পারে এবং উভয় নির্বাচন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা আছে।
- তাই দুটি নির্বাচন আলাদা হওয়া উচিত।
ডা. শফিকুর রহমান বলেন, “আমাদের দাবি জনগণের জন্য, দলের জন্য নয়। নির্বাচিত হলে আমরা জনগণের জন্য আন্তরিকতার সঙ্গে পিআর প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন করব। অতীতের রাজনৈতিক সংস্কৃতি পরিবর্তন করা আমাদের লক্ষ্য।”
সমাজের অংশগ্রহণ, রোহিঙ্গা সমস্যা ও প্রথম ১০০ দিনের পরিকল্পনা
জামায়াত আমির ইইউ প্রতিনিধিদের জানিয়েছেন, নির্বাচিত হলে:
- সমাজের সকল মানুষের অংশগ্রহণ ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
- রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের জন্য কার্যকর পরিকল্পনা গ্রহণ।
- নির্বাচিত হলে প্রথম ১০০ দিনে জনগণের কল্যাণে কার্যক্রম বাস্তবায়ন।
তিনি বলেন, “আমাদের সব পরিকল্পনা প্রস্তুত। প্রয়োজন হলে আমরা তা প্রকাশ করব। মেনিফেস্টোতেও এসব বিষয় সংযুক্ত করা হয়েছে।”
চাকরি, শিক্ষা, মাইগ্রেশন ও অর্থনীতি নিয়ে বৈঠক
ডা. শফিকুর রহমান বলেন, “ইইউ প্রতিনিধিরা চাকরি, মাইগ্রেশন, শিক্ষা বিনিময় এবং অর্থনীতি নিয়ে আলোচনা করেছেন। তাদের পরামর্শ ও কথাগুলো আমাদের কাছে আন্তরিক মনে হয়েছে। তারা আসলেই বাংলাদেশকে ভালোবাসে এবং ভবিষ্যতে একটি উন্নত বাংলাদেশ দেখতে চায়।”
সাংবাদিকদের ভূমিকা
জামায়াত আমির দেশের সাংবাদিকদের ভূমিকার প্রশংসা করে বলেন, “দেশ গঠনে সাংবাদিকদের অংশগ্রহণ স্বতস্ফূর্ত, আন্তরিক ও ব্যাপক হবে বলে আমরা প্রত্যাশা করি। আমরা চাই সাংবাদিকরা দেশ এবং জনগণের স্বার্থে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করুন।”
বিএনপি চেয়ারপারসনের অসুস্থতা নিয়ে মন্তব্য
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “সুস্থতা-অসুস্থতা আল্লাহর ওপর নির্ভরশীল। দেশের মানুষ তাঁর জন্য দোয়া করছে। আমাদের থাকার বা না থাকার সঙ্গে সমাজের চাকা থেমে থাকার কোনো সম্পর্ক নেই। তবে যারা শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য, তাদের প্রতি সবার খেয়াল রাখা উচিত।”
সংক্ষেপে জামায়াতের মূল বক্তব্য
- ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার না করা।
- ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের সময়সূচি অনুসারে নির্বাচন।
- জাতীয় সরকার গঠন ও দুর্নীতি বিরোধী নীতি।
- সব মানুষের অংশগ্রহণ ও সমান বিচার নিশ্চিত করা।
- যুব সমাজের আকাঙ্ক্ষা ও দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে অক্ষত রাখা।
- প্রথম ১০০ দিনে জনগণের জন্য কার্যক্রম বাস্তবায়ন।
- সাংবাদিকদের দায়িত্বশীল ভূমিকা এবং জনগণের কল্যাণে কাজ।
ডা. শফিকুর রহমান স্পষ্ট করেছেন, জামায়াত ধর্মকে ব্যবহার করে রাজনীতি করে না। নির্বাচনের সময়সূচি, জাতীয় সরকার, দুর্নীতি বিরোধী নীতি, যুব সমাজের স্বার্থ এবং সমাজের সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণ তাদের মূল অগ্রাধিকার। ইইউ কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠকে এসব বিষয় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে এবং দেশের উন্নয়নের জন্য জোরালো পরিকল্পনার কথাও প্রকাশ করা হয়েছে।
MAH – 14185 I Signalbd.com



