বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে ধর্মের ব্যবহার ও রাষ্ট্র কাঠামো নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, ধর্ম মানুষের ব্যক্তিগত বিশ্বাস হলেও রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে ধর্মকে বিভাজনের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা দেশের জন্য সবচেয়ে বড় ক্ষতি বয়ে আনবে। তিনি বলেন, আমরা ধর্মভীরু মানুষ, কিন্তু ধর্ম দিয়ে রাষ্ট্র বিভাজন কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। একটি গোষ্ঠী পরিকল্পনা করে এ ধরনের বিভাজন সৃষ্টি করতে চাইছে, যা দেশকে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিতে পারে।
রোববার (৭ ডিসেম্বর) রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে বিএনপির নতুন কর্মসূচি “দেশ গড়ার পরিকল্পনা” উদ্বোধন অনুষ্ঠানে তিনি এই বক্তব্য দেন। অনুষ্ঠানে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য, যুব সংগঠনের প্রতিনিধিরা, বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ এবং নীতি নির্ধারকরা উপস্থিত ছিলেন।
মির্জা ফখরুলের বক্তব্য শুধু বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির সমালোচনা নয়, বরং দেশের সামগ্রিক দিক নির্দেশনা, ভবিষ্যতের রাজনৈতিক কাঠামো, তরুণ প্রজন্মের পরিবর্তিত মানসিকতা এবং বিএনপির নতুন রাজনৈতিক পরিকল্পনার দিকগুলো সামনে আনে।
ধর্মের নামে বিভাজন সৃষ্টির সমালোচনা
মির্জা ফখরুল বলেন, বাংলাদেশের মানুষ ধর্মপ্রাণ, কিন্তু ধর্ম নিয়ে রাজনীতি সবসময়ই সংবেদনশীল বিষয়। তিনি অভিযোগ করেন, একটি শক্তি পরিকল্পনা করে ধর্মকে ব্যবহার করে রাষ্ট্রকে বিভক্ত করার চেষ্টা করছে। তাদের উদ্দেশ্য হলো মানুষের মধ্যে বিভাজন তৈরি করা এবং সমাজে বিদ্বেষ ছড়ানো।
তার মতে, ধর্মকে কেন্দ্র করে সংঘাত সৃষ্টি করার চেষ্টাগুলো শুধু রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে করা হচ্ছে, যার সঙ্গে জনগণের প্রকৃত স্বার্থের কোনো সম্পর্ক নেই। তিনি বলেন, বাংলাদেশের মানুষ কখনোই ধর্মের নামে বিভেদের রাজনীতি সমর্থন করেনি। দেশ প্রতিষ্ঠার সময় থেকেই বাংলাদেশ অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত।
এই প্রেক্ষাপটে তিনি বলেন, “আমরা আমাদের ধর্ম পালন করি, কিন্তু ধর্মকে রাষ্ট্রীয় বিভাজনের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার হতে দেব না।”
১৫ বছর পর গণতন্ত্র ফিরে আসার সুযোগ
ফখরুল দাবি করেন, দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে দেশে গণতন্ত্র ক্রমশ দুর্বল হয়েছে। নির্বাচন ব্যবস্থা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে, প্রশাসন দলীয়করণ হয়েছে এবং বিরোধী রাজনীতিকে দমন করা হয়েছে। এই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসার জন্য এখন নতুন সুযোগ এসেছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
তিনি বলেন, জনগণ পরিবর্তন চায়। দেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলন এখন বাস্তব রূপ নিতে শুরু করেছে। যদিও সেই পথে বাধা রয়েছে, ষড়যন্ত্র রয়েছে, কিন্তু গণতন্ত্রের জন্য জনগণকে এগিয়ে আসতেই হবে।
তিনি আরও বলেন, “গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা একদিনের কাজ নয়। এটি এক দীর্ঘ প্রক্রিয়া। আমাদের এই প্রক্রিয়া শুরু করতে সাহস ও সততা দরকার।”
সাইবার অপপ্রচারের বিরুদ্ধে সতর্ক থাকতে নির্দেশ
বর্তমান সময়ে রাজনৈতিক প্রচারণার বড় অংশ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমভিত্তিক। মির্জা ফখরুল অভিযোগ করেন, বিএনপিকে ঘিরে নিয়মিত অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। সাইবার ওয়ারের নামে বিভিন্ন ধরনের ভুল তথ্য, বিভ্রান্তিকর পোস্ট, ডিজিটাল প্রচারণা ছড়িয়ে দলটির ভাবমূর্তি নষ্ট করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, “আজকের রাজনীতিতে সাইবার যুদ্ধ বাস্তব। এ ক্ষেত্রে আমাদের তরুণদের সচেতন থাকতে হবে। ভুয়া তথ্যের বিরুদ্ধে সত্য তথ্য ছড়িয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।”
তিনি বিএনপির তথ্য ও গবেষণা বিভাগ, বিশেষ করে তরুণ আইটি কর্মীদের আরও সংগঠিত হওয়ার নির্দেশ দেন।
আওয়ামী লীগ আমলে ধ্বংস হওয়া প্রতিষ্ঠান পুনর্গঠন করতে হবে
ফখরুল অভিযোগ করেন, দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকার ফলে আওয়ামী লীগের আমলে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে ব্যাংক খাত, প্রশাসন, নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে ব্যাপক বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়েছে।
তিনি বলেন, রাষ্ট্রকে টিকিয়ে রাখতে হলে প্রথমেই এসব প্রতিষ্ঠানকে পুনর্গঠনের উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। নাগরিকের অধিকার, সুশাসন, জবাবদিহিতা—এসব ফিরে পেতে হলে প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করতে হবে।
তার ভাষায়, “দুর্নীতির কারণে ব্যাংকগুলো দেউলিয়া হওয়ার পথে। শিক্ষা ব্যবস্থা ব্যবসায়িকীকরণ হয়েছে। স্বাস্থ্য ব্যবস্থা দুর্বল। এসব পরিবর্তন ছাড়া রাষ্ট্র নতুন করে দাঁড়াতে পারবে না।”
তরুণ সমাজের মানসিকতা পরিবর্তন—নতুন বাংলাদেশ গড়ার দাবি
মির্জা ফখরুলের বক্তব্যে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে তরুণ প্রজন্মের প্রসঙ্গ। তিনি বলেন, তরুণরা এখন আর পুরোনো ধাঁচের রাজনীতি চায় না। তারা আধুনিকতা, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, চাকরির সুযোগ, স্টার্টআপ সুবিধা, নিরাপদ ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম—এসবের দাবি করছে।
তিনি বলেন, “তরুণদের মধ্যে নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন রয়েছে। তারা নতুন রাষ্ট্র কাঠামো চায়। পুরোনো পদ্ধতিতে দেশ এগোবে না।”
তরুণদের এই আকাঙ্ক্ষাকে কেন্দ্র করেই বিএনপি নতুন পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে বলে তিনি জানান।
বিএনপিকে আধুনিকভাবে পুনর্গঠনের ঘোষণা
তিনি বলেন, বিএনপি নতুন চিন্তার আলোকে দলকে পুনর্গঠনের কাজ শুরু করেছে। শুধু পুরোনো নেতৃত্ব দিয়ে দল চালানো যাবে না। তরুণ, দক্ষ ও যোগ্য মানুষকে নেতৃত্বে আনা হবে।
তিনি জানান, দলের নীতিনির্ধারণী কমিটিতেও পরিবর্তন আসবে। নতুন ধারণা, গবেষণা, প্রযুক্তির ব্যবহার—এসবকে গুরুত্ব দিয়েই দলকে নতুন পথে নিয়ে যেতে চান।
দেশ গড়ার পরিকল্পনা: কী রয়েছে এই কর্মসূচিতে
বিএনপির নতুন কর্মসূচি “দেশ গড়ার পরিকল্পনা” মূলত তিনটি ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে।
১. রাষ্ট্র সংস্কার
- নির্বাচন কমিশনের পূর্ণ স্বাধীনতা
- বিচার বিভাগকে নির্বাহী ক্ষমতা থেকে মুক্ত করা
- প্রশাসনে দলীয়করণ বন্ধ
- দুর্নীতি দমন কমিশনকে স্বাধীন ক্ষমতা প্রদান
২. অর্থনৈতিক কাঠামোর আধুনিকায়ন
- ব্যাংক খাতে সুশাসন
- ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগে বিনিয়োগ
- বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার নীতি
- প্রবাসী অর্থনীতি শক্তিশালীকরণ
- প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনভিত্তিক অর্থনীতিতে রূপান্তর
৩. তরুণ প্রজন্মকে কেন্দ্র করে উন্নয়ন পরিকল্পনা
- স্টার্টআপ ইনকিউবেটর ও ফান্ড
- আইটি ও প্রযুক্তি শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা
- দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ
- সাইবার সিকিউরিটি খাত শক্তিশালী করা
- নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি
এই পরিকল্পনায় বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে পরামর্শ করা হয়েছে, বিশ্বব্যাপী সফল উন্নয়ন মডেলগুলোও বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে।
রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপট
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির প্রভাব বৃদ্ধি পেয়েছে। ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা—সব দেশেই রাজনৈতিক দলগুলো ধর্মীয় আবহে নিজেদের অবস্থান তৈরি করার চেষ্টা করছে। বাংলাদেশেও মাঝে মাঝে ধর্মের নামে রাজনীতির উত্তাপ দেখা যায়।
এমন পরিস্থিতিতে মির্জা ফখরুলের বক্তব্যকে বিশেষজ্ঞরা দেখছেন একটি স্পষ্ট অবস্থান হিসেবে। কারণ তিনি বলছেন, বাংলাদেশের জনগণ ধর্মপ্রাণ হলেও ধর্মকে রাজনৈতিক বিভাজনের অস্ত্র হিসেবে দেখতে চায় না।
বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মূল ভিত্তি ছিল অসাম্প্রদায়িকতা। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় জনগণ এক কণ্ঠে বলেছিল—ধর্ম নয়, জাতি, ভাষা ও স্বাধীনতার ভিত্তিতে বাংলাদেশ গড়ে উঠবে।
এই ঐতিহাসিক সত্যকে সামনে রেখে তিনি বর্তমান প্রজন্মকে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় ঐক্যবদ্ধ থাকতে আহ্বান জানান।
গণতান্ত্রিক কাঠামো পুনর্গঠনের আহ্বান
তিনি বলেন, গণতন্ত্র মানে শুধু নির্বাচন নয়। গণতন্ত্র মানে জবাবদিহিতা, স্বচ্ছতা, নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করা। দেশে প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হলে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সহনশীলতা ও বোঝাপড়া বাড়াতে হবে।
তিনি বলেন, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে শত্রু মনে করে রাজনীতি চললে রাষ্ট্র কখনোই টেকসই হতে পারে না।
তরুণদের উদ্দেশে বার্তা
ফখরুল বলেন, বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ তরুণদের ওপর নির্ভর করছে। তাদের মুক্ত চিন্তা, তাদের প্রযুক্তিগত সক্ষমতা এবং তাদের সাহস এই দেশকে এগিয়ে নেবে।
তিনি বলেন, “দেশ গঠনের দায়িত্ব এখন তরুণদেরই হাতে। তারা যদি এগিয়ে আসে, বাংলাদেশ পরিবর্তিত হবেই।”
সারসংক্ষেপ
- ধর্মভীরু হলেও ধর্ম দিয়ে রাষ্ট্র বিভাজনকে বিএনপি প্রত্যাখ্যান করেছে।
- ১৫ বছর পর গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার সুযোগ এসেছে বলে দাবি করেছে দলটি।
- সাইবার দুনিয়ায় অপপ্রচারের বিরুদ্ধে সতর্ক থাকার আহ্বান জানানো হয়েছে।
- রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান পুনর্গঠনের পরিকল্পনা তুলে ধরা হয়েছে।
- তরুণদের কেন্দ্র করে ‘নতুন বাংলাদেশ’ ধারণা সামনে আনা হয়েছে।
- দলকে আধুনিক কাঠামোয় পুনর্গঠনের ঘোষণা দিয়েছেন মির্জা ফখরুল।
এই সংবাদটি বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি বিএনপির নতুন রাজনৈতিক অবস্থান ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার একটি পূর্ণাঙ্গ রূপরেখা।
MAH – 14176 I Signalbd.com



