নির্বাচন কমিশনার (ইসি) অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, সরকারি পদে থেকে কেউ আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না। রবিবার (৭ ডিসেম্বর) রাজধানীর আগারগাঁওয়ের নির্বাচন ভবনে সিইসির সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত কমিশন সভা শেষে তিনি সাংবাদিকদের এই তথ্য জানান। একইসঙ্গে তিনি নিশ্চিত করেন, চলতি সপ্তাহেই ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হবে এবং এবার ভোটগ্রহণের সময় এক ঘণ্টা বাড়ানো হচ্ছে। ইসি সানাউল্লাহর এই ঘোষণা অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাদের নির্বাচনে অংশ নেওয়া নিয়ে চলমান জল্পনা-কল্পনার মধ্যে একটি কঠোর প্রশাসনিক বার্তা দিল।
নির্বাচন নিয়ে ইসির কঠোর সিদ্ধান্ত
নির্বাচন কমিশনার আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহর বক্তব্য অনুযায়ী, নির্বাচন কমিশন আসন্ন নির্বাচনকে নিয়ম এবং আইনের কাঠামোর মধ্যে রাখতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
উপদেষ্টাদের অংশগ্রহণ: সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ইসি সানাউল্লাহ বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের দুই উপদেষ্টা স্বপদে বহাল থেকে নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন কিনা, তা ‘সময় হলেই দেখতে পাবেন’। তবে তিনি স্পষ্ট করে দেন, “এটা (নির্বাচনে অংশ নেয়া) কারোরই সম্ভব নয়।”
আইনের বাধ্যবাধকতা: তিনি জোর দিয়ে বলেন, “আইন যাদের পারমিট করবে তারাই নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে।” এর অর্থ হলো, উপদেষ্টা পরিষদের কোনো সদস্য পদে বহাল থেকে ভোট করতে পারবেন না, যদি না পদত্যাগ করে আইনগত যোগ্যতা অর্জন করেন।
নতুন প্রকল্প অনুমোদন: তফসিলের পর উপদেষ্টা পরিষদ নতুন কোনো প্রকল্প অনুমোদন করতে পারবে না। এই সিদ্ধান্তটি নির্বাচনকালীন সময়ে সরকারি ক্ষমতার অপব্যবহার রোধে ইসির কঠোরতা প্রমাণ করে।
তফসিল ঘোষণা ও সময়সূচি পরিবর্তন
নির্বাচন কমিশনার সানাউল্লাহ ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার সময় সম্পর্কেও একটি স্পষ্ট ধারণা দিয়েছেন।
ঘোষণার সময়: তিনি জানান, চলতি সপ্তাহের মধ্যেই সংসদ নির্বাচন ও গণভোটের জন্য তফসিল ঘোষণা করা হবে।
সিইসি’র ভাষণ: তফসিল উপলক্ষে বিটিভির মাধ্যমে জাতির উদ্দেশে ভাষণ রেকর্ড করা হবে। কমিশন এই ভাষণ রেকর্ড করার জন্য বিটিভিকে চিঠি দেবে।
ভোটের সময় বৃদ্ধি: নির্বাচন কমিশন এবার ভোটগ্রহণের সময় এক ঘণ্টা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সকাল সাড়ে ৭টায় ভোটগ্রহণ শুরু হয়ে চলবে বিকেল সাড়ে ৪টা পর্যন্ত। এই সময় বৃদ্ধি ভোটারদের জন্য একটি ইতিবাচক দিক।
নির্বাচনের স্বচ্ছতা ও নিরাপত্তার নিশ্চয়তা
ইসি সানাউল্লাহ অতীতের নির্বাচনগুলোর বিতর্কিত ‘রাতের ভোট’ নিয়েও মন্তব্য করেন এবং কঠোর নিরাপত্তা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিতের আশ্বাস দেন।
‘রাতের ভোট’ নয়: ইসি সানাউল্লাহ বলেন, “এবার রাতের ভোটের মতো কোনো ঘটনা ঘটবে না।” নির্বাচনের আগের রাতে ব্যালটসহ ভোটগ্রহণের সব সামগ্রী কেন্দ্রে পাঠানো হবে। এর অর্থ হলো, ভোটের দিন সকালে সব সামগ্রী কেন্দ্রে পৌঁছানো হবে।
ম্যাজিস্ট্রেট মোতায়েন: আচরণবিধি প্রতিপালনে কঠোরতা আনতে তফসিল ঘোষণার দিন থেকেই প্রতিটি উপজেলায় দুইজন করে ম্যাজিস্ট্রেট থাকবে। ভোটের পাঁচ দিন আগে ম্যাজিস্ট্রেটের সংখ্যা আরও বাড়ানো হবে।
পোস্টার অপসারণ: নির্বাচনী পোস্টার নিয়ে তিনি বলেন, তফসিল ঘোষণার পর ৪৮ ঘণ্টা সময় দেওয়া হবে পোস্টার সরাতে, না সরালে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
অন্যান্য নির্বাচনী প্রস্তুতি ও ব্যবস্থাপনা
কমিশন সভা শেষে নির্বাচন কমিশনার সানাউল্লাহ আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের কথা জানান:
ছুটির ঘোষণা: ভোটের দিন সাধারণ ছুটি থাকবে।
ব্যাংক ও পোস্ট অফিস: ব্যাংক, পোস্ট অফিস ইসির প্রয়োজন অনুযায়ী খোলা থাকবে। নির্বাচনী কার্যক্রম পরিচালনার জন্য এসব প্রতিষ্ঠানের সহায়তা অপরিহার্য।
কমিশন সভা: রবিবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ের নির্বাচন ভবনে সিইসির সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত কমিশন সভা শেষে তিনি সাংবাদিকদের এই তথ্যগুলো দেন। সভায় ইসির জ্যেষ্ঠ সচিব আখতার আহমেদও উপস্থিত ছিলেন।
রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া ও আইনগত বাধ্যবাধকতা
ইসি সানাউল্লাহর এই ঘোষণা রাজনৈতিক মহলে মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাদের মধ্যে যারা নির্বাচনে অংশ নিতে আগ্রহী, তাঁদেরকে এখন দ্রুত তাঁদের পদ থেকে পদত্যাগ করতে হবে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ইসির এই কঠোরতা নির্বাচনকে নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য করার জন্য অপরিহার্য। বিশেষ করে অন্তর্বর্তী সরকারের কাঠামো নিয়ে বিতর্ক থাকায়, ইসির উচিত প্রতিটি সিদ্ধান্ত আইন মেনে চলা এবং সব দলের জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করা। ইসি সানাউল্লাহর বক্তব্য ‘পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল হলে সংবিধানে পুরোপুরি ফিরবে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা’—এই ধরনের আইনি বিতর্কের বাইরে গিয়ে নির্বাচনকে সামনে নিয়ে আসার ইসির ইচ্ছাকে প্রতিফলিত করে।
আইনের শাসন ও নিরপেক্ষ নির্বাচন
সরকারি পদে থেকে কেউ নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না বলে নির্বাচন কমিশনার আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহর কঠোর ঘোষণা ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করার ইসির অঙ্গীকারকে তুলে ধরেছে। চলতি সপ্তাহেই তফসিল ঘোষণা এবং ভোটগ্রহণের সময় এক ঘণ্টা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নির্বাচন প্রস্তুতির ক্ষেত্রে একটি বড় অগ্রগতি। এখন দেখার বিষয়, নির্বাচন কমিশন তাদের ঘোষিত কঠোরতা বজায় রেখে একটি সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে পারে কিনা।
এম আর এম – ২৫২৬, Signalbd.com



